গত কিছুদিন ধরেই বিশ্ব রাজনীতি এবং প্রযুক্তি জগৎ এই দুই জায়গাতেই আলোচনার বিষয়বস্তু একটাই। সেটা হচ্ছে পেগাসাস স্পাইওয়ার. বিশ্বজুড়ে নানান দেশের মানবাধিকার কর্মী সাংবাদিক আইনজীবী ও রাজনীতিকদের ফোনের নজরদারি চালানোর ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর ইজরায়েলের বেসরকারি কোম্পানি nso গ্রুপের তৈরি করা এই সফটওয়্যার নিয়ে এখন তুমুল তরজা চলছে দুনিয়া জুড়ে । চলুন কথা বলি দুনিয়া ওলট পালট করে দেওয়া স্পাইওয়ার সম্পর্কে ।
পেগাসাস মূলত একটি নজরদারি বিষয়ক সফটওয়্যার । ইজরাইলের সংস্থা এনএসও ই সফটওয়্যার তৈরি করেছে। যা দিয়ে যে কারো মোবাইলে আড়ি পাতা যায়. এটা কিন্তু সাধারণ কোন নজরদারি নয়. আগে ফোনে আড়ি পেতে শুধু দুই প্রান্তের কথাবার্তা শোনা যেত. আর সফটওয়্যারের মাধ্যমে গোটা ফোনটারই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় হ্যাকাররা. ফোনের কথাবার্তা WhatsApp এর চ্যাট, ছবি, ফোনে কি কি তথ্য আছে সবই জানা যায়. আরো ভয়ানক ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল যিনি ব্যবহার করছেন তিনি জানতেই পারেন না যে তার ফোন হ্যাক করা হয়েছে. সমস্ত তথ্য পাচার হয়ে যাচ্ছে নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর কাছে. কিন্তু কারো ফোনে পেগাসাস software install করতে হলে তো সেই ফোনটাকে আগে হাতের নাগালে পেতে হবে. তাই না? এখানেও মেগাসাস অন্য যে কোনো হ্যাকিং সফটওয়্যারের চাইতে শত গুণ উন্নত. সাধারণ হ্যাকিং সফটওয়্যারের ইমেইল বা অন্য কোন মাধ্যমে হ্যাকরদের তরফ থেকে একটি ওয়েবসাইটের লিঙ্ক পাঠানো হয়. সেই স্প্যাম লিংকে ক্লিক করলেই সফটওয়্যারটি ডাউনলোড হয়ে যায়. পেগাসাসে নতুন যেটা আছে সেটা হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েস বা ভিডিও কল করেও এই সফটওয়্যারের যেকোনো ফোনে ইন্সটল করা যায়. ধরুন আপনার WhatsApp এ Unknown নাম্বার থেকে একটা কল এলো. আপনি সেটা রিসিভ করলেন.
আপনার অজান্তেই ফোনে ইন্সটল হয়ে যাবে এই সফটওয়্যার আপনি জানতেও পারবেন না. ফোনের ভেতরে ভয়ানক এক গুপ্তচরকে নিয়ে ঘুরছেন আপনি. পেগাসাস নামের এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে কি কি করা যায় শুনলে চমকে উঠবেন যে কেউ. প্যাগাসিসের মাধ্যমে আপনার ফোনে রাখা সমস্ত তথ্য ভান্ডার চলে যাবে অন্যের হাতে. আপনার ফোনে ঢুকে হ্যাকাররা কথা রেকর্ড করতে পারবে. জিপিএস ট্র্যাক করে আপনার লোকেশন জেনে নিতে পারবে. গোপনে আপনার ক্যামেরা অন করতে পারবে। ম্যাসেজ করতে পারবে, হোয়াটস্যাপ মেসেজ দেখতে পারবে, সমস্ত পেগাসাস জেনে নিতে পারবে. শুধু তাই নয়, আপনাকে ফাঁসানোর জন্য চাইলে আপনার ফোনে ষড়যন্ত্রমূলক কোন ছবি, ভিডিও কিংবা ফাইলও রেখে দেওয়া যাবে. পরে পুলিশ এসে টুটি চেপে ধরবে আপনার. এই কারণেই পেগাসাস কে বলা হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সফটওয়্যার. আপনি হয়তো ভাবছেন আরে আমি তো লাখ টাকা দামের আইফোন ব্যবহার করি. এই ফোনের সিকিউরিটি সিস্টেম খুব শক্তিশালী. তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে আছেন. প্যারাসাসের সফটওয়্যারের কাছে অ্যান্ড্রয়েডও যা আইফোনও তা . l
আইফোনের নিরাপদ সিকিউরিটি সিস্টেম ভাঙতেও এর জুরি নেই. আবার অনেকে ভেবে বসছেন হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামের ম্যাসেজ তো পেগাসাস করা. সেন্ডার এবং রিসিভার ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সেগুলো পড়া সম্ভব নয়. ভুল. আপনার ফোনে পেকেসাস স্পাইভার ইন্সটল করে দিলে সব WhatsApp বা টেলিগ্রামের ম্যাসেজও অনায়াসে দখল নিতে পারবে হ্যাকাররা. শুধু তাই নয় আপনার অজান্তেই কাউকে মেসেজ পাঠাতেও পারবে মেসেজ রিসিভ করে আপনি দেখার আগে সেটা ডিলিটও করে ফেলতে পারবে. আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করে ছোট্ট একটা সফটওয়্যার? আপনাদের একটু অতীতে নিয়ে যাচ্ছি. বেশি দূরে নয়. দু হাজার ষোলো সালে. সে বছরই পেগাসাদের প্রথম দিককার একটি সংস্করণের কথা গবেষকরা জানতে পারেন. সেই সময় নির্দিষ্ট ব্যক্তির ফোনে টেক্সট মেসেজ বা ইমেল পাঠানো হতো. যাতে থাকতো কোন লিঙ্ক. সেই লিঙ্কে ক্লিক করলেই ফোনের দখল নিতো পেগাসাস. কিন্তু সেই সময়ের তুলনায় এনএসও তাদের এই নজরদারির যন্ত্রের অনেক উদ্ভাবন ঘটিয়েছে. এখন লিংকে ক্লিক না করলেও ফোনের দখল নিতে পারে পেগাসাস. আবার সফটওয়্যারের ত্রুটি বা বাগ ব্যবহার করেও এই স্পাইওয়ার ঢুকে পড়তে পারে ফোনে কোনো ত্রুটির কথা হয়তো ফোন প্রস্তুতকারকও জানেন না।
দু হাজার উনিশ সালে হোয়াটস্যাপ জানিয়েছিল ওই ধরনের ত্রুটির সুযোগ নিয়ে এনএসওর সফটওয়্যার চোদ্দোশো ফোনে ম্যালওয়্যার পাঠিয়েছিল। সেই জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তির ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে শুধু একটি কল করা হতো। আর এই কলের মধ্য দিয়েই পেগাসাসের কোড ফোনে ইনস্টল হয়ে যেত। সাম্প্রতিক সময়ে অ্যাপেলের আই মেসেজ সফটওয়্যারের বাগ ব্যবহার করে স্পাইওয়ার পাঠানো শুরু করে এমএসও. সাধারণত ফোন কেনার সময় ইন্সটল করা থাকে এরকম কোন সফটওয়্যার. যেমন আই মেসেজ অথবা খুব জনপ্রিয় কোনো software যেমন WhatsApp । এসব software এর coding এর খুঁটি খুঁজে বের করে NSO এর মত কোম্পানি গুলো. কারণ তাতে একসঙ্গে বহু ফোনে spy weight সরানোর সুযোগ পাওয়া যায়. এ ধরনের ক্ষেত্রে ফোনের মালিক স্পাইওয়ারবাহী মেসেজে ক্লিক না করলেও তার ফোন অটোমেটিক হ্যাকড হয়ে যায়. ভিক্টিমদের ফোনের ফরেনসিক অ্যানালাইসিস করে দেখা গেছে সাধারণ কৌশলে কাজ না হলে টার্গেটের আশপাশ থেকে কোন ওয়ারলেস ট্রান্সমিশন ব্যবহার করেও নির্দিষ্ট ফোনে পেগাসাস ঢুকিয়ে দেওয়া যায়. একবার ফোনে ঢুকে পড়তে পারলেই এই স্পাইওয়ার প্রায় সব ধরনের তথ্য বা ফাইল কব্জা করার সুযোগ পায়. এসএমএস, এড্রেস বুক, কল হিস্ট্রি, ক্যালেন্ডার, ইমেল এবং ইন্টারনেটের ব্রাউজিং ও হিস্ট্রি সব সে দেখতে পারে. পেগাসাস, যখন কোন আইফোনে সফলভাবে আক্রমণ করে তখন সফটওয়্যারটি ওই ফোনের বা ডিভাইসের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পাওয়ার পেয়ে যায়. ফোনের মালিক যা করতে পারেন পেগাসাস তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করতে পারে.
পেগাসাস কারা ব্যবহার করে? অর্থাৎ এর ক্রেতা কারা? এখানে একটা তথ্য জানিয়ে রাখি পেগাসাদের সার্ভিস কিনতে চার কোটি টাকার মতো খরচ হয়. আর প্রতি দশ জনের ফোনে ইন্সটল করতে পাঁচ কোটি টাকা করে গুনতে হয়. প্রশ্ন আসে এমন সফটওয়্যার বানানোর দরকার কি ছিল? কারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই স্পাইওয়ার ব্যবহার করে. আর কেনই বা করে? কাদের ফোনেই বা আড়ি পাতা হয় এনএসও দাবি করছে তারা পেগাসাস সফটওয়্যার তৈরি করেছে যাতে বিভিন্ন দেশের সরকারি গোয়েন্দা বিভাগ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এটা ব্যবহার করে জঙ্গি সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করতে পারে। ম্যাক্সিকো সরকার দাবি করছে যে তারা এই পেগাসাস ব্যবহার করে সেখানকার ড্রাগ লর্ড এলচ্যাপুকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু এটা কেবল মুদ্রার একটা পিঠ এই সফটওয়্যারটার বেশিরভাগ দেশে ব্যবহৃত হয় শুধুমাত্র বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ এবং ভিন্ন মতাবলম্বী লোকেদের নজরদারিতে রাখার জন্য। এই পেগাসাস সফটওয়্যারের মাধ্যমেই যেমন ভারত সরকার বিরোধী দলের নেতা রাহুল গান্ধীর ফোনে আড়ি পেতেছিল বলে জানা গেছে. শুধু রাহুলই নন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, সাংবাদিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা সহ প্রায় তিনশো লোকের উপর পেগাসিসের মাধ্যমে নজরদারি চালানোর অভিযোগ আছে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে. এদের সবাই সরকারের বিরোধী হিসেবে পরিচিত. অর্থাৎ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারগুলো নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের ওপর স্পাইগিরি চালাচ্ছিল দিনের পর দিন ধরে. এই যে বাংলাদেশে কয়দিন পর পরই ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটে.
Facebook এ সেসব নিয়ে মজা করার পাশাপাশি কখনো কি ভেবেছেন? এতে করে যে নাগরিকদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে. আপনার টাকা খরচ করে যে মানুষের ব্যক্তিগত গোপীনিয়তা লঙ্ঘন হচ্ছে. এই ভাবনা কি এসেছে মাথায়? পেগাসাসের ব্যবহারকারী দেশগুলোর নামের তালিকা এখনো প্রকাশিত হয়নি. কিন্তু সেই তালিকায় যে বাংলাদেশের নাম নেই সেটা কি গ্যারান্টি দিয়ে বলা সম্ভব? বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক গার্ডিয়ান সহ মোট সতেরোটি গণমাধ্যম একত্রিত তদন্ত করে এই পেগাসাস কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে এনেছে. এটা আরো একটা বিরল দৃষ্টান্ত. এর আগে কখনোই একটা ইস্যুর পেছনে এতগুলো মিডিয়া হাউস একসঙ্গে ছোটেনি. এবার ছুটেছে. কারণ গোটা বিষয়টার সঙ্গে পৃথিবীর মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা জড়িত. বলছি না পেগাসাসের মতো সফটওয়্যারের দরকার নেই. মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য এমন স্পাইওয়ার খুবই কার্যকর. কিন্তু নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে যদি স্বৈরাচারী শাসকের ক্ষমতার মসনদ রক্ষার কাজে এইসব সফটওয়্যারের বেশি ব্যবহার করা হয়. গোটা ব্যাপারটাতে জড়িয়ে যায় ব্যবসা আর ক্ষমতা ধরে রাখার নোংরা খেলায় । তাহলে সেই স্পাইওয়ার মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারটাই বেশি করবে. পেগাসাসের বেলায়ও ঠিক সেটাই ঘটেছে.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন