যদি বলি আপনার চোখ দেখতে পারে না এমন গভীর ও প্রায় অনাবিষ্কৃত একটা পৃথিবী আছে. হয়তো বলতে পারেন যে মহাবিশ্বে কত গ্রহই তো আছে? সব খোঁজ কি আমরা পেয়েছি? কিন্তু যদি বলি আমাদের এই পৃথিবীর ভেতরে আরো একটি জগত আছে এবং যে জগৎ ছড়িয়ে আছে আমাদের গোটা বিশ্ব জুড়ে. এইবার হয়তো নড়েচড়ে বসবেন. হ্যাঁ আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে এমন এক রাজ্য যে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না. এটাকে বলা হয় অণুবীক্ষণিক বিশ্ব. এই অণুবীক্ষণই বিশ্ব প্রচন্ড আকর্ষণীয় ও চমকে দেওয়ার মতো. কি কি ঘটছে এখানে তা আমার আপনার কল্পনারও বাইরে. এটা যেন কোনো ভিন গ্রহ বাসীদের রাজ্য. সম্ভাবনার দুয়ার খুলে রাখা আছে এই অণুবীক্ষণিক বা nano বিশ্বে.
ন্যানো কি ন্যানো হলো পরিমাপের একক। এক মিটারের একশো কোটি ভাগের এক ভাগ হচ্ছে এক ন্যানো। আর ন্যানো টেকনোলজি হলো বিজ্ঞানের এই অতি ক্ষুদ্র স্তরে একটা কিছু তৈরী করা আসলে শুধু তৈরি করা না. ন্যানোমিটার স্কেলে পরিবর্তন, পরিবর্তন, ধ্বংস বা সৃষ্টি সম্পর্কিত টেকনোলজিকেই ন্যানো টেকনোলজি বলে. অর্থাৎ ন্যানোমিটার স্কেলে পরিমিত যেকোনো বিষয়ে বহুমাত্রিক টেকনোলজিকে ন্যানো প্রযুক্তি বা ন্যানো টেকনোলজি বলা যেতে পারে. কথা হচ্ছে কতটা ক্ষুদ্র স্তরে কাজ করে ন্যানো টেকনোলজি.
বর্তমান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সবচাইতে আশ্চর্যজনক নিদর্শন ন্যানো টেক. আমরা এমন এক পৃথিবীর সাথে পরিচিত যেখানে আমরা মিটার কিলোমিটার গ্রাম বা লিটার. এমনকি মিলিমিটার ইত্যাদি পরিমাপের সাথে অভ্যস্ত. কিন্তু এমন কোন জিনিসের আকার সম্পর্কে কল্পনা করাও কষ্টের যেটা এতটাই ছোট যে চোখে দেখা সম্ভব নয়. এক কাজ করুন. নিজের মাথা থেকে একটা চুল ছিঁড়ে আঙ্গুলে নিন. এখন এই চুলের ব্যস কত হতে পারে? খুবই কম. তাই না? এখন যদি বলি মানুষের চুল প্রায় এক লক্ষ ন্যানোমিটার ব্যাসবিশিষ্ট. বা একটা কলমের আকার দাগ প্রায় মিলিয়ান ন্যানোমিটার প্রশস্ত হয়. তাহলে হয়তো বুঝতে পারবেন কতটা ক্ষুদ্র এক ন্যানোমিটার. বলা হয় ভবিষ্যৎ পৃথিবী হতে যাচ্ছে ন্যানোটেকলজির রাজত্ব. . ন্যানো টেকনোলজিতে তৈরি হচ্ছে অণুবীক্ষণে সব রোবট. যেগুলোকে ন্যানো বোর্ড বলা হয়. হার্ট কিংবা লিভার. যেটার ই হোক না সমস্যা. সেখানেই পৌঁছে যাবে ন্যানো রোবট.
না কাটাছেঁড়া করে প্রবেশ করা নয় আপনার রক্তের প্রবাহে সাধারণ সিরিঞ্জের মাধ্যমে প্রবেশ করবে এই সব রোবট । দেবের চিকিৎসা তাহলে চিন্তা করুন টেকনোলজি কতটা ক্ষুদ্র স্তরে কাজ করছে কেন তা গুরুত্বপূর্ণ । কারণ পারমানবিক স্তরে বিজ্ঞানের কাজ করার অর্থ হলো পদার্থের পরমাণুগুলোকে নতুন করে সাজানোর একটা সুযোগ. আমরা সবাই জানি এই পৃথিবীর সবকিছুই পরমাণু দিয়ে তৈরি. আমরা যাই খাই যাই পড়ি আর যেখানেই বাস করি এমনকি আমাদের দেহ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব কিছুই। আর ন্যানো টেকনোলজিতে বদলে দেওয়া সম্ভব পদার্থের গঠন । আমরা সবাই লেগো ব্লগস এর সাথে পরিচিত । যেভাবে লেগো ব্লগস খুলে পুনরায় বিভিন্ন ভাবে সাজানো সম্ভব একই ভাবে ন্যানো টেকনোলজিতে পদার্থের গঠন বদলে ফেলা সম্ভব । যা এক বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয় ও আমাদের মহাবিশ্বকে আরো ভালোভাবে জানার সুযোগ তৈরি করে দেয়. বিজ্ঞান এই ন্যানো সাইন্সের মাধ্যমে আমাদের বিশ্বকে একদমই নতুন আকার দিতে পারে. বদলে ফেলা সম্ভব পদার্থের গলনাঙ্ক বা স্ফুটনাঙ্ক বিদ্যুৎ বা চুম্বক পরিবাহকতা, রাসায়নিক বিক্রিয়া ইত্যাদি. সমুদ্রের নোনাপানিকে বদলে সুপেয়ো করে ফেলা সম্ভব. সম্ভব পানি থেকে আর্সেনিক নামক বিষ দূর করা. সুপীয় পানি নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে তা অনেকটাই কেটে যাচ্ছে ন্যানো টেকের কারণে. ন্যানো টেকনোলজির বেশিরভাগ সুবিধা হয়তো ভবিষ্যৎ কয়েক দশকের মধ্যে চোখে দেখতে পাওয়া যাবে. কিন্তু বর্তমানেও এই প্রযুক্তি নানান ভাবে আমাদের পৃথিবীকে পরিবর্তিত করতে সাহায্য করছে. আপনি হয়তো ভাবছেন ন্যানো টেকনোলজি একেবারে অসাধারণ জিনিস. এবং এটি সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তি. কারণ টেকনোলজি বলতে আমরা মানুষের তৈরি টেকনিক কি মনে করি? কিন্তু আমাদের জীবন নিজ থেকেই ন্যানো টেকনোলজির এক বিরাট উদাহরণ. আমাদের শরীরে প্রোটিন, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, কোষ ইত্যাদি ন্যানো টেকনোলজির সূত্রেই কাজ করে. আমাদের খাদ্যাভ্যাস বদলে দিতে পারে. ইতিমধ্যে তা শুরুও হয়ে গেছে. আপনার খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করার সাথে আরো স্বাস্থ্য সম্মত করে গড়ে তুলবে পুষ্টিগত দিক থেকে. যেমন খাদ্যের প্রয়োজন হবে অনেক কম লবণ বা চিনির পরিমান. অথচ স্বাদ থাকবে ঠিক আগের মতো. যাদের উচ্চ রক্তচাপ তাদের চিন্তা আর করতে হবে না মিষ্টি খেতে. বিভিন্ন খাদ্যজাত পণ্যের প্যাকেজিং ও প্রলেপ তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহৃত হচ্ছে । এটা জাস্ট একটা উদাহরণ. ন্যানো টেকনোলজিতে তৈরি কাপড়গুলোর তন্তু এতটাই সূক্ষ্ম যে এতে ধূলি, বালু কণা আটকে থাকতে পারে না. ফলে কাপড় অনেক কম নোংরা হয়. অনেক সানস্ক্রিন ক্রিমে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়. এতে ক্রিমটি আপনার স্কিনে লাগানো মাত্র এটি টাইটেনিয়াম অক্সাইড অথবা জিঙ্ক অক্সাইডের আস্তরণ ফেলে দেয়. ফলে এটি সূর্যের ক্ষতিকর আলট্রাভায়োলেট রশ্মিকে ব্লক করে ফেলে. এমনকি ন্যানো টেকনোলজির সাহায্যে বিভিন্ন কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরি করা সম্ভব.
ইলেকট্রনিক ডিভাইসে এই প্রযুক্তির কথা বলে শেষ করা যাবে না. আপনার হাতে স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপই আছে এই প্রযুক্তি. প্রসেসর দিন দিন উন্নত হচ্ছে. অথচ আরো কম বিদ্যুৎ বা ব্যাটারি খরচ করছে এই কারণে. হাতে স্মার্ট ফোন এখন স্ক্র্যাচ প্রুফ, ন্যানো টেকের কারণে.
কম্পিউটার চিপ শব্দটি শুনে আমরা অভ্যস্ত. একটি কম্পিউটার শিপে ন্যানো টেকের কারণে এখন প্রায় দুই বিলিয়ন ট্রানজিস্টর অনায়াসেই এটে যেতে পারে. যার প্রতিটি এক একটি স্বতন্ত্র ট্রানজিস্টারের কাজ করে. চিন্তা করুন তাহলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তিকে এই ন্যানো টেকনোলজি. এক সময় বিশাল কম্পিউটার এখন আরো অনেক বেশি দ্রুতগতির এবং কার্যকর ক্ষমতা নিয়ে আপনার চোখের কন্টাক্ট লেন্সে অবস্থান করতে পারছে অনায়াসে. শুরু হয়ে গেছে ফ্লেক্সিবল বা বাঁকানো সম্ভব ডিসপ্লে ফোনের বাজার. টিভির পর্দা হয়ে উঠছে ক্যালেন্ডারের পাতার মতোই পাতলা যাকে বলা হচ্ছে wallpaper টিভি.
সব সম্ভব হয়ে উঠেছে. ওই যে ন্যানো প্রযুক্তির কারণে. শুধু তাই নয়. প্রতিদিন পৃথিবীতে বৃদ্ধি পাচ্ছে আবর্জনা. আশা করা যাচ্ছে ন্যানোটেক বিশাল ভূমিকা রাখবে পৃথিবীকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রে । ন্যানো প্রযুক্তিতে কোন প্রকার কার্বন উৎপাদন না করেই আবর্জনা ধ্বংস করা সম্ভব. সম্ভব আরো সুনিপুন ভাবে সমস্ত আবর্জনা রিসাইকেল করা. এর ফলে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে বায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে অনায়াসেই কমিয়ে দেওয়া যাবে গ্রিনহাউস এফেক্ট.
পরিবেশ হয়ে উঠবে আরো সুন্দর, আরো পরিচ্ছন্ন. শুধুমাত্র অনুর কাঠামোগত পার্থক্য হবার কারণেই কয়লা এত সস্তা আর হীরা এত দামি. এতদিন পর্যন্ত অনুপমানুর সংযোগ শুধুমাত্র রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমেই সংগঠিত হতো. ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে অনুপরমাণুকে ভেঙে কিংবা জোড়া লাগিয়ে অনেক কিছুই করার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে. ন্যানো টেকনোলজিতে কয়লাকে হিরায় পরিণত করা সময়ের ব্যাপার মাত্র. কিন্তু সাইড এফেক্ট থাকবে না তা তো আর হয় না. অবশ্যই আছে. সাইড এফেক্ট নির্ভর করছে কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এই প্রযুক্তি তার উপর. আপনার ব্যক্তিগত বলতে হয়তো তখন আর কিছুই থাকবে না এই ন্যানো টেকনোলজির কারণে । আমাদের দেহের মাঝে কিভাবে চিপ প্রবেশ করবে তা আমরা টেরও পাবো না. ডেটা ট্রান্সফার হতে থাকবে নিয়মিতভাবে আমাদের অজান্তেই. বদলে যেতে পারে সহজেই জীবনযাত্রা. ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে পরিস্থিতি. আপনার চলাফেরা দৈনন্দিন কাজকর্ম সহ প্রতিটা বিষয়ের খুঁটিনাটি চলে যাবে আরেকজনের হাতে. নিশ্চয়ই তা চাইবেন না আপনি. আসলে প্রযুক্তি দিন দিন উন্নত হচ্ছে তাতে আপনার বা আমার এই বিষয়ে কিছুই করার নেই. ন্যানো টেকনোলজি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের রাজত্ব শুরু হতে খুব বেশি দেরি নেই.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন