স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভেবেছেন কখনো? নিশ্চয়ই ভাবছেন জেগে জেগে দিবাস্বপ্ন দেখার কথা বলছি না তো? কিন্তু না, রীতিমতো ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্নও নিয়ন্ত্রণের কথাই বলছি, আপনার ইচ্ছামত স্বপ্ন দেখবেন। ইচ্ছা মতো নিয়ন্ত্রণ করবেন। আর পছন্দ না হলে অর্থাৎ দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করলে সেটার গতিপথ পাল্টে দেবেন একেবারে নিমেষে। আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় এটা খুবই সম্ভব একে বলা হয় লুসিভ ড্রিম। লুসিড ড্রিমিং এর সাথে আপনারা অনেকেই হয়তো পরিচিত আছেন। অনেকে পরিচিত থাকলেও হয়তো এটা কেন হচ্ছে বা কিভাবে হচ্ছে তা নিয়ে বেশ দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছে এসবেরই উত্তর মিলবে আজকের এই লিখাতে।
লুসিড ড্রিম অর্থ কি? সহজ বাংলায় অনুবাদ করতে গেলে বলা যায় লুসিড অর্থ পরিষ্কার. অর্থাৎ স্পষ্ট আর dream মানে তো আমরা সবাই জানি যে স্বপ্ন। লুসিড ডিম হলো সেই স্বপ্ন যে আমাদের স্পষ্ট ভাবে মনে থাকে এবং স্বপ্ন চলাকালীন সময়েও আমরা এ উপলব্ধি করতে পারি যে এটি বাস্তব নয় বরং এটি স্বপ্ন কিন্তু শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থ দিয়ে লুসিড ড্রিম ব্যাখ্যা করলে ভুল হবে একটু অন্যভাবে বলা যাক ।
মনে করুন স্বপ্নে আপনি কি পাহাড়ের উপর থেকে দ্রুত গতিতে নিচে পড়ে যাচ্ছেন এবং নিচে পড়বার পর আপনার বাঁচার কোন সম্ভাবনাই নেই। হুট করে আপনি ভাবছেন, ইস যদি পাথরের মধ্যে একটা নরম বিছানা থাকতো তাহলে হয়তো আপনি বেঁচে যেতে পারতেন। যেই ভাবনা সেই কাজ, আপনার ভাবনা অনুযায়ী স্বপ্নটা মডিফাই হয়ে গিয়ে আপনি পড়লেন একটা নরম বিছানার ওপরে এটাই হচ্ছে লুসিড ড্রিম । এবার চলুন দেখি লুসিড ড্রিম কেন? এবং কিভাবে হয় ? তবে লুসিড ড্রিম কিন্তু এই যুগের আবিষ্কৃত কোনো বস্তু নয়। বলছি শুরুর কথা, সর্বপ্রথম গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল এই নিয়ে প্রথম ধারণা দেন। এছাড়াও আরো অনেক বিজ্ঞানী বর্তমানে এর উপর গবেষণা করছেন। অ্যারিস্টটল তার ঘুমের মাঝে একদিন লুসিড ড্রিম উপলব্ধি করে লিখেছিলেন যে মাঝেমধ্যে ঘুমানোর পরেও তার সচেতন একটা অংশ জাগ্রত থাকে এবং স্বপ্ন দেখার মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি স্বপ্ন দেখছেন। লুসিড ড্রিম শুধু স্বপ্ন নয় এটি হলো আপনার brain power.
বিভিন্ন বিভিন্ন স্থানের সাধু সন্ন্যাসী গণ রীতিমতো লুসিড ড্রিমের চর্চা করেন এবং এটাকে তারা গ্রীন ইয়গা নামে ডেকে থাকেন। কারণ লুসিড ড্রিম মানসিক শক্তি এবং সৃজনশীলতা বাড়াতে সরাসরি সহায়তা করে। আমরা গড়ে প্রতিদিন ঘুমের মাঝে প্রায় চার থেকে ছয় বার স্বপ্ন দেখে থাকি। তবে বেশিরভাগ স্বপ্নই আমরা ভুলে যাই। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে দৈনিক দেখা স্বপ্নগুলোর মধ্যে ঠিক কোন স্বপ্নগুলো লুসিড ড্রিম এর অংশ হতে পারে। তো আমরা কখন লুসিড ড্রিম দেখি? বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের ঘুমকে দুটো পর্যায়ে ভাগ করা যায়- রেম এবং নন রেম স্লিপ। রেম শব্দটি মূলত ইংরেজি রেপিড আই মুভমেন্টের সংক্ষিপ্ত রূপ। ঘুমিয়ে পড়ার প্রায় নব্বই মিনিটের মাথায় রেম পর্যায় শুরু হয়। এই ধাপে আমাদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত সক্রিয় থাকে। পৃথক্রিয়া বৃদ্ধি পায় এবং চোখের পাতার কাপন বেড়ে যায়। চোখের পাতার কাঁপন থেকেই এই পর্যায়ের নাম হয়েছে রেপিড আই মুভমেন্ট বা রেম । অপরদিকে নন রেম অবস্থায় আমাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়া, ঋত্বক ক্রিয়া এবং চোখের পাতার কাঁপন. অনেকটাই কম থাকে।
কিত্ত হেরেন নামের একজন প্যারাসাইকোলজিস্ট লুসিড ড্রিম কিভাবে হয় তার জানার জন্য উনিশশো সত্তর সালে একটি গবেষণা শুরু হয়। তিনি দেখেন যে লুসিড ড্রিমিং যিনি সাধারণত রেম স্লিপের সময় ঘটে থাকে। সাধারণত রেম স্লিপ থেকেই স্বপ্ন দেখার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়। ঘুমের যে কোন পর্যায়ে আমরা স্বপ্ন দেখলেও রেম পর্যায়ের স্বপ্ন অনেকটাই প্রাণবন্ত হয়ে থাকে। মুলত এই ধাপে লুসিড ডিম দেখা যায়। লুসিড ডিমের উপর একজন ব্যক্তিটি কতটুকু কর্তৃত্ব খাটাতে পারবেন তা ব্যক্তি ভেবে ভিন্ন হয়ে থাকে। অনেকে লুসিড ড্রিম এ নিজের অস্তিত্ব টের পাওয়ার সাথে সাথেই জেগে ওঠেন । আবার অনেকেই দিব্যি স্বপ্নের ঘটনা নিজের ইচ্ছামত বদলে দিতে থাকেন। ঠিক কি কারণে একটা স্বপ্ন লুসিড ড্রিম হিসেবে দেখা হয় তা পরিষ্কার জানা যায়নি এখনো। তবে স্বপ্ন বিশারদ ডক্টর ম্যাথি ও ওয়াকারের মতে আমাদের মস্তিষ্কের যুক্তি তর্ক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে যেই অংশ সেটা এর পেছনে দায়ী। রেম ঘুমের সময় মস্তিষ্কের এই অংশ নিষ্ক্রিয় থাকার কথা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অংশ সষ্ক্রিয় হয়ে উঠলে আমরা একই সাথে স্বপ্ন দেখি এবং যুক্তি বিচার করতে পারি। এ ধরনের ঘটনা ব্যক্তিকে স্বপ্নের মাঝেও সজাগ থাকার সক্ষমতা প্রদান করে। সম্ভবত এই কারণে আমরা লুসিড ড্রিম দেখে থাকি। সাধারণত আমাদের মনের দুটো অংশ থাকে. সচেতন এবং অবচেতন মন। আমরা স্বপ্ন দেখি, অবচেতন মনে কিন্তু স্বপ্নের মাঝে সচেতন মন খানিকটা সক্রিয় হলেই এই লুসিভ ড্রিমিং শুরু হয়। অর্থাৎ চেতন ও অবচেতন মনের একটা বিরল সংমিশ্রণে এমনটা হয়ে থাকে।
লুসিড ড্রিম এর সময় আমরা স্বপ্নটা বেশ পরিষ্কার ভাবে দেখতে পাই এবং স্বপ্নে প্রদত্ত অনুভূতিগুলো খুবই তীব্র হয়। প্রায় বাস্তবের মতই এবং যে কেউ চাইলেই স্বপ্নের দৃশ্যগুলো নিজ ইচ্ছা মতো সাজিয়ে নিতে পারেন। লুসিড ড্রিম বাদে অন্য সাধারণ স্বপ্নগুলোতে কিন্তু স্বপ্নের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আমার নিজ হাতে নিয়ে নিতে পারি না। আপনি হয়তো বছরের পর বছর ধরে কোন দুঃস্বপ্ন দেখছেন। কখনো হয়তো স্বপ্নের আপনাকে কিছু সাপ ধাওয়া করছে অথবা কখনো হয়তো ভয়ঙ্কর সব দৈত্য দানবেরা আপনার পিছু নিয়েছে। ঘুম থেকে ওঠার পর এই স্বপ্নের কারণে আপনার মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। কোন কিছুতেই মন ভালো হচ্ছে না বছরের পর বছর। এই দুঃস্বপ্নের জন্য একই মানসিক অবসাদ ঘিরে আছে আপনাকে। ঠিক এখানেই লুসিড ড্রিম এর ব্যবহার। আপনি লুসিড ড্রিমকে ব্যবহার করে দুঃস্বপ্নে আপনাকে ধাওয়া করার সাপ এবং দৈত্যদেরকে মেরে ফেলতে পারবেন। লুসিড ড্রিম আপনার দুঃস্বপ্নগুলোকে সুন্দর স্বপ্নে রূপান্তরিত করে স্বপ্ন বিষয়টাকে আপনার জীবনে একটা মোটিভেশন হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম। এর সম্পূর্ণটাই আপনার মনস্তাত্ত্বিক এর উপর নির্ভর করে।কেউ কেউ লুসিড ড্রিম এমনিতেই দেখতে পারেন।
আবার কারো কারো ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় চর্চা। আমরা যখন স্বপ্ন দেখি ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথে আমাদের পরিষ্কার মনে থাকলেও খানিকটা পরেই কিন্তু আবার ভুলে যাই। সেক্ষেত্রে বিছানার পাশে সবসময় একটা ডায়েরি এবং কলম রাখতে হবে যেন ঘুম থেকে স্বপ্ন দেখে উঠে সেখানে লিখে রাখা যায়। এটা স্বপ্ন মনে রাখতে সাহায্য করে এবং স্বপ্নের সময় চেতনাও অনেক বেশি সজাগ হয়ে থাকে। এ ছাড়া কিছু ড্রাগসও আছে যা কৃত্রিম উপায়ে মানুষকে লুসিড ড্রিম খাতে সাহায্য করে. লুসিড ড্রিমের বিনোদন আর অ্যাডভেঞ্চারের পাশাপাশি এরও কিন্তু রয়েছে উপকারিতা।
যদিও লুসিড ড্রিম কে নিরাপদ ধরা হয় তবে যাদের মানসিক অসুস্থতা বা কোনো সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য একটা বিরাট ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। লুসিড ড্রিম এর মধ্যে আপনাকে জেগে থাকতে হচ্ছে । এজন্য হয়তো আপনার ঘুমের প্রধান উদ্দেশ্যটাই ব্যাহত হবে। বিশ্রাম এবং ঘুমের অভাবে আপনার শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে ব্যাপকভাবে। এই ঘুমের ব্যাঘাত আপনার মানসিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিতে পারে। আবার যেহেতু আপনি স্বপ্নের মাঝেও জেগে আছেন তাই স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে তালগুল লেগে যেতে পারে । অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে ব্যক্তি কোনটা বাস্তব আর কোনটা স্বপ্ন তা নির্ধারণ করতে হিমশিম খেয়ে যায় । এ ধরনের যে কোন সমস্যা বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনে।
তাই লুসিড ড্রিমের পূর্বে নিজের মানসিক স্থিরতা এবং বিশ্রাম নিয়ে কোনো কার্পণ্য করা যাবে না। এবার খুব বড়সড় সুযোগ আপনার সামনে। চাইলে এখন আপনি নিজেও কিন্তু ঘুরে আসতে পারেন স্বপ্নের জাদুকড়ি দুনিয়া থেকে। স্বপ্নের ইচ্ছে হলে আপনিও পাখির মতো উড়ে যেতে পারেন বা যা ইচ্ছা করতে পারেন। স্বপ্নের সেই পুরো পৃথিবীটা শুধুই আপনার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন