একদিকে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে. অন্যদিকে চাকরিদাতারা বলছেন যোগ্য লোকের অভাব. আসলে বিষয়টা কি?
বেকার সমস্যা. বিশাল জনগোষ্ঠী, দেশ, বাংলাদেশের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুতর একটা সমস্যা. সমস্যাটা আরো গুরুতর যখন এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যাই বেশি. বিআইডিএস এর এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার চৌত্রিশ শতাংশ এবং স্নাতক পর্যায়ে এই হার সাইত্রিশ শতাংশ যুক্ত রাজ্যের প্রভাবশালী সময় কিনা ইকোনমিস্টের কলামেও বলা হয়েছে বর্তমানে বাংলাদেশের সাতচল্লিশ শতাংশ স্নাতকই বেকার. অর্থাৎ প্রতিবছর যদি বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর সহ উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে সারে তিন লাখ মানুষও বের হয় তবে তাদের প্রায় অর্ধেকই থেকে যাবে কর্মহীন।
কেন এত এত বিএসসি, এমএসসি, বিবিএ, এমবিএ, বিএ, এমএস সার্টিফিকেটধারী উচ্চশিক্ষিত তরুণ তরুণী দিন শেষে বেকার থেকে যাচ্ছে হ্যাঁ এটা সত্য যে চাকরি প্রত্যাশীদের বিপরীতে যথেষ্ট কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই. কিন্তু আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষিতদের অনেকেই যখন বেকার তখন প্রতিবেশী দেশ থেকে বহু মানুষ বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে মোটা টাকা স্যালারিতে কাজ করছে. বাংলাদেশে কর্মনিত বিদেশিদের সংখ্যা কত হতে পারে? জানলে অবাক হবেন দেশের বিভিন্ন কোম্পানি সহ মাল্টি ন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় দশ লাখ বিদেশি এই মুহূর্তে কাজ করছে যাদের বেশিরভাগই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা. তাদের একেকজনের বেতন প্রায় পাঁচ জন বাংলাদেশি কর্মকর্তার বেতনের সমপরিমাণ কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও বেশি. কর্মসংস্থানের অভাব আছে সত্য কিন্তু যাও বা আছে সেখানেও কেন আমাদের উচ্চশিক্ষিত বেকার তরুণীরা সুযোগ পাচ্ছে না.
certificate? নাকি দক্ষতা? যদি বলি শুধুমাত্র দক্ষতা না থাকার কারণেই পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে আমাদেরকে. বাংলাদেশের যুবসমাজ স্কুল কলেজে যে শিক্ষা পাচ্ছে সেটা তাদেরকে কর্ম জীবনের জন্য পরিপূর্ণরূপে তৈরি করতে পারছে না ।
এর কারণ হিসেবে বলা যায় বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা কারিগরি ও কমিউনিকেশনস এর দক্ষতা এবং কৌশলগত কর্ম ব্যবস্থাপনায় পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশ যেমন ভারত, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, এমনকি ভুটানের চেয়েও অনেক পিছিয়ে রয়েছে. চীনে দুহাজার বিশ সালে প্রকৃত গ্রাজুয়েটের সংখ্যা ছিল বিয়াল্লিশ লাখের সামান্য একটু বেশি. একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায় আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষিতের হার চীনের চেয়ে কিন্তু কম নয়. অথচ পার্থক্যটা দেখুন. বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, বিআইজিডি এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে করা এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কম্পিউটার ও ইংরেজি ভাষায় আত্মবিশ্বাসী মাত্র ষোলো শতাংশ । গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী মাত্র চোদ্দ শতাংশ তরুণ তরুণী কারিগরি প্রশিক্ষণ পেয়েছে। আবার ওই দক্ষতার মাপকাঠিতে দক্ষ তরুনের হার চব্বিশ শতাংশ অর্থাৎ নারীদের কম্পিউটারে দক্ষতার হার মাত্র দশ শতাংশ. অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতায় এগিয়ে মাত্র একুশ শতাংশ তরুণ. যেখানে নারীদের এই ভাষাগত দক্ষতার হার মাত্র চোদ্দ শতাংশ. এখানে ছোট্ট করে বলে রাখি skill development এর ওপর বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে বাংলাদেশে. কিন্তু দক্ষ করে তোলার ব্যাপারে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়েও আছে প্রশ্ন. ডেইলিস্টারের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় দেশের সত্তর শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে তাদের চাকরির বাজারের জন্য তৈরিতে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তেমন কোন অবদান নেই. অথবা এই ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নন.
আবার তাদের পাঠ্যসূচি একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সহায়ক এমন প্রশ্নেও পঁচাত্তর শতাংশ শিক্ষার্থীর মতামত নেতিবাচক । এছাড়াও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অনেক বিভাগ আছে যেগুলোর জন্য আক্ষরিক অর্থে কোন চাকরির ব্যবস্থাই নেই. যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলাম বা ল্যাব ফেসিলিটি আপডেট হচ্ছে না. অথচ যুক্তরাষ্ট্রের রকগার স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট এন্ড লেবার রিলেশনসের অধ্যাপক বিল ক্যাশেল মতে, সব প্রতিষ্ঠানে ভবিষ্যতের চাহিদার কথা চিন্তা করে প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিকে মনোযোগী হচ্ছে. আর এসব দক্ষতা অর্জনের জন্য সার্টিফিকেট নয়. অধ্যাবসায় ও উদ্যোগ প্রয়োজন. সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে চাকরির বাজার. বদলাচ্ছে প্রয়োজনীয় দক্ষতা.
world economic forum এর মতে আগামী দশকের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী এক বিলিয়নেরও বেশি চাকরি অর্থাৎ বিশ্ব চাকরি বাজারে প্রায় এক তৃতীয়াংশই প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে । সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাইশ সালের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো যে প্রযুক্তিগত দক্ষতাগুলোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে তার শীর্ষে রয়েছে বিগ অ্যানালিটিকস মেশিন লার্নিং, ক্লাউড কম্পিউটিং ইত্যাদি আর এর কোনোটি সেভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শেখার কোনো ব্যবস্থা এখনো নেই । কেননা কর্মক্ষেত্রের চাহিদার কথা ভেবে শিক্ষা কার্যক্রমের যে পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়নি.
আগামী দশ বছরে কোন শিল্পগুলোই মানুষ দরকার হবে এবং কি ধরনের দক্ষতা আমাদের প্রয়োজন পরবে? এখানে অটোমেশানের কথা মাথায় রাখা হচ্ছে কিনা, অটোমেশিন নিয়ে আমরা আলাদা পর্ব তৈরী করবো. সার্টিফিকেট কি তাহলে শুধুই সামাজিক মর্যাদা? না এটা একটা আত্মপরিচয়. একটা সময় ডিগ্রি বা সার্টিফিকেশনকে নিজেকে প্রমান করার লাইসেন্স মনে করা হলো.
কেউ কেউ ভাবতো শুধু ডিগ্রী বা সার্টিফিকেশন থাকলেই যেকোনো নিয়োগ কর্তা আপনাকে বিবেচনা করবে. এখন আর সেটা দেখা যায় না. বরং আপনার প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকলে আপনি কিছুই করতে পারবেন না. মজার বিষয় হচ্ছে বিশ্বব্যাপী প্রায় সাতান্ন দশমিক পাঁচ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রীধারীদের চাকরি জীবনে তাদের পড়াশোনার বিষয় কোনো কাজেই আসে না লিংকিং এর সিও যেক উইনার বলেছেন চাকরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রাসঙ্গিক দক্ষতা । সেক্ষেত্রে আপনি কিভাবে আপনার দক্ষতা অর্জন করেছেন? তা কিন্তু বিবেচ্য বিষয় নয়. এই তো কয়েক বছর আগে, এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপেল কম্পিউটার ইনকপোরেটেডে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ কর্মীরই স্নাতক ডিগ্রি নেই । শুধু অ্যাপেল নয় নিউয়র্গ টাইমস কে দিয়ে এক সাক্ষাৎকারে গুগলের মানবসম্পদ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট লাজলু বক বলেন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়া গুগুল কর্মীর সংখ্যা ধীরে ধীরে পাচ্ছে। গুগলের কিছু টিমে চোদ্দ শতাংশ কর্মীর প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রি নেই.
তবে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন আগের চেয়ে অনেক আপডেটেড. তাঁরাও নিয়মিত চেষ্টা করে যাচ্ছে একাডেমিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে. নিজেকে দক্ষ করে তোলার। তাদের কেউ কেউ ভার্সিটি শেষ করার পর নিজে নিজে চেষ্টা করে আবার কেউ কেউ নিজে নিজে চেষ্টা করে সুবিধা করতে না পারলে শরণাপন্ন হয় বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে । বাংলাদেশের মতো একটি দেশ যে দেশে যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে স্কুল ডেভেলপমেন্টের তেমন কোনো সুযোগ নেই সেখানে বিভিন্ন আই টি ইনস্টিটিউতের মতো স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে আজ শেষ করতে চলেছি আমরা তার আগে বিশ্বের বড়ো বড়ো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকানো যাক বেশ কয়েকটি বিশ্ব বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এই ড্রপ আউটের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন যেমন মাইক্রোসফ্টের বিল গেটস , ফেসবুকের মার্ক জাকার্গবার্গ , টুইটারের জ্যাক Dorsey, ডেলের মাইকেল দেল, উবারের ট্রেভিস, হোয়াটসঅ্যাপের জেন কাম। অতএব তাদের কাছ থেকে কেন ডিগ্রী খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় সেটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। অর্থাৎ আগামী দিনে দেখা যাবে তারাই ভালো জব পাচ্ছে যাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা আছে সেক্ষেত্রে কার কতগুলো ডিগ্রি আছে সেটা কিন্তু মোটেও বিবেচিত হবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন