গুটঘুটে অন্ধকার, কনকনে ঠান্ডা আর জলের চাপ হলো আট টন। অর্থাৎ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে প্রায় পনেরো হাজার সাতশো পঞ্চাশ পাউন্ড। অবাক করা বিষয় হলো এখানেও প্রাণের অভাব নেই। এখানকার বাসিন্দারা সংখ্যায় যেমন অনেক তেমনি বৈচিত্রেও কম নয়। কোনটি দেখতে অতীব বীভৎস আবার কোনটি বিষ্ময় জাগায় । অথচ এই গভীরতম বিন্দুর রহস্য এখনো অনেকটাই ভেদ করা সম্ভব হয়নি। পৃথিবীর গভীরতম স্থান মারিয়ানা ট্রেন্স।
এতটাই গভীর যে আপনি যদি মারিয়ানা ট্রেন্সের নিচে আস্ত মাউন্ট এভারেস্ট স্থাপন করেন তবুও মাউন্ট এভারেস্টের শিখর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার ফুট নিচে থাকবে। মারিয়ানা ট্রেন্সের সম্পর্কে আজও পুরোটা জানা সম্ভব হয়নি বলেই পৃথিবীর মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও বিস্ময়কর স্থান এটি। বহু মিথ আছে একে ঘিরে। যার বেশিরভাগই অপমানি।.
মারিয়ানা আইল্যান্ডসের সবচেয়ে বড় দ্বীপ গোয়া। এখানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খুবই শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি। মারিয়ানার আর একটি দ্বীপ তিনিয়ন। উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালে এখান থেকেই জাপানে বোমা হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ষোলশো আটষট্টি সালে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম দিকে দ্বীপপুঞ্জে কলোনি স্থাপন করে স্পেনীয়রা । তারা স্পেনের রানী মারিয়ানা অফ অস্ট্রিয়ার নাম দিয়ে দ্বীপের নামকরণও করে মারিয়ানা আইল্যান্ড। তবে তারা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি এই দ্বীপগুলোর পূর্ব পাশের জায়গাটি পৃথিবীর গভীরতম স্থান। সেই দ্বীপুঞ্জের নামেই রাখা হয়েছে মারিয়ানা ট্রেন্সের নাম। এখানকার সবচেয়ে গভীর অংশটির নাম চ্যালেঞ্জের টিপ। চ্যালেঞ্জের টু নামক একটি জাহাজের নাবিকেরা উনিশশো আটচল্লিশ সালের পৃথিবীর গভীরতম এই বিন্দু আবিষ্কার করে। বিজ্ঞানীদের মতে এই স্থান প্রায় এগারো কিলোমিটার গভীর। যদিও বিজ্ঞানীরা এখনো জোর গলায় বলতে পারছেন না যে এটি আসল গভীরতা। মারিয়ানা ট্রেন্সের সৃষ্টি হয়েছে tectonic প্লেটের সংঘর্ষের কারণে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের সঙ্গে ফিলিপিন প্লেটের সংঘর্ষের ফলে বিশাল আকৃতির প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট ফিলিপিন ফ্লেটের নিচে চলে আসে। আর এভাবেই প্রশান্ত মহাসাগরের তলবে সে জন্ম নেয় এই গভীর খাত। সেই হিসেবে মারিয়ানা খাতের বিস্তার তুলনামূলক অনেক কম। উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় দুহাজার-পাঁচশো-পঞ্চাশ কিলোমিটার ধরে বিস্তৃত।
সমুদ্রে এক হাজার মিটারের পর থেকে আর আলু পৌঁছায় না। ফলে চ্যালেঞ্জের দ্বীপ অংশটিতে পানির তাপমাত্রা এক থেকে চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। পানির অতিরিক্ত চাপের কারণে চ্যালেঞ্জার দ্বীপ যেকোনো মানুষের জন্যই বিপদজনক জায়গা। এখানে সাধারণ সাবমেলিন চলতে পারে না। মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা যেমন দুঃসাধ্য তার চেয়েও কঠিনbচ্যালেঞ্জের দ্বীপের গভীরতম বিন্দু পর্যন্ত যাওয়া।মাউন্ট এভারেস্ট এখনো পর্যন্ত অনেকেই জয় করেছেন। কিন্তু চ্যালেঞ্জের দ্বীপের গভীরতম বিন্দুতে এখনো পর্যন্ত চারবার অভিযান চালিয়েছে মানুষ। উনিশশো ষাট সালে ইউএস নেভির লেফটেন্যান্ট ডং ওয়েলফ ও জ্যাকটু স্পিকার প্রথম ম্যারিইয়ানা ট্রেন্সের তলায় অবতরণ করেন। এরপর উনিশশো ছেষট্টি ও দু হাজার নয় সালে দুবার মানুষ অবতরণ করেছে ভয়ঙ্কর এই স্থানে ।
দু হাজার বারো সালে বিখ্যাত জেমস ক্যামেরা এখানে অবতরণ করেন। তার ভাষ্য মতে চাঁদ জয় করার চেয়েও কঠিন মানিয়না ট্রিঞ্চের তলদেশে যাওয়া। তবে সম্প্রতি আরেক অভিযাত্রী ভিক্টর ভিস্কোপও পৌছেছেন দশ হাজার নশো সাতাশ মিটার পর্যন্ত। যা এখনো রেকর্ড হিসেবে আছে। এই গভীর সমুদ্রের তলদেশে কি আছে? সে বিষয়ে একটু পরে আসছি। ছাব্বিশে মার্চ দু হাজার বারো সালে ডিপসি চ্যালেঞ্জের নামের এক সবুজাভ হলুদ রঙের সাবমার্সিবলে করে মালিয়ানা ট্রান্সের গভীরে যাত্রা শুরু করেন জেমস ক্যামেরা। যাত্রা শুরুর আড়াই ঘন্টা পর দশ হাজার আটশো আটানব্বই মিটার গভীরতায় পৌঁছান তিনি। তখন এটা ছিল বিশ্ব রেকর্ড. তিনি সমুদ্রের গভীরতম অঞ্চলে পৌঁছেছিলেন।
ভাগ্যক্রমে আমাদের দেখার জন্য তিনি ডুব দিয়ে ছিলেন থ্রিডি হাই ডেফিনেশন ক্যামেরা সহ। দু হাজার চোদ্দ সালে মুক্তি পায় এই নিয়ে documentary DC challenge। আর এতেই দেখা যায় যে সমুদ্রের গভীরতম স্থানেও প্রাণের উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ব বিদ্যমান। হতে পারে মারিয়ানা খাত পৃথিবীর সবচেয়ে অনাবিষ্কৃত সীমান্ত। মারিয়ানা খাদের নিচে হিমশিতল জলে যেখানে কোনো আলো নেই এবং ভয়ঙ্কর চাপ তবুও তার জীবন কিভাবে সহ্য করে এটা জানার জন্য বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা ব্যস্ত হয়ে আছেন। সাধারণত সংযোগস্থলের গভীরে মৃত প্রাণীর কঙ্কাল খোলস জমা পড়তে থাকে । মারিয়ানার তলও আলাদা নয়। এখানকার জলের রং সেজন্যই খানিকটা হলুদ। কখনো হাইড্রোজেন সালফাইট সহ বিভিন্ন ধরনের খনিজ সমৃদ্ধ গরম পানিও বের হয় চ্যালেঞ্জার দ্বীপের ছিদ্রপথ দিয়ে। এগুলো প্রভাব খাদ্য, ব্যারো ফিলিক জাতীয় ব্যাকটেরিয়া। এসব ব্যাকটেরিয়াকেই আবার খেয়ে বাঁচে অণুবীক্ষণিক যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয়। এমন কতগুলো ছোট ছোট জীব. এদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে মাছেরা।
এভাবেই সাগরের ওপরের মতো সাগরের তলেও এতো গভীরে জীবনের চক্র কিন্তু ঠিকই চলতে থাকে। এখানে বেঁচে থাকার যুদ্ধের প্রথম অন্তরায় হলো গাঢ় অন্ধকার। বেশিরভাগ মাছই চোখে দেখতে পায় না এখানে। ড্রাইভ ফিশ নামের মাছের নামকরণ করা হয়েছে এর বিশাল ডানার জন্য। এরা তাদের ডানা মাটিতে পায়ের মতো ব্যবহার করে। সাথে শিকার বোঝার জন্য স্পর্শ এবং কম্পনের ওপরও নির্ভর করে এই মাছ। আবার অনেক মাছ আছে যাদের নিজস্ব আলো রয়েছে। এই আলো বায়োলিউমিনেশনস নামে পরিচিত। ল্যান্ডটন ফিশ বা এই জাতীয় মাছেরা এই আলোকে হেডলাইটের মতো ব্যবহার করে। শিকার কে আকর্ষণ করার জন্য তারা এই আলো ব্যবহার করে। অন্ধকার এরপর দ্বিতীয় সমস্যা তৈরি করে। সূর্যের আলোর অভাব মানে খাদ্য শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কোন শ্যাওলা বা গাছপালা নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই খাবারের অভাব হওয়ার কথা। ফলে সমুদ্রের ওপরের স্তর থেকে মৃত প্রাণীর ক্ষয়িষ্ণু বর্জ্যের উপর নির্ভর করেই তাদের বেঁচে থাকতে হয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে ফ্রিঞ্চের গভীর পানির টানে এই বর্জ্যগুলো আরো বেশি করে তলায় পৌঁছায়। ফলে একটা অদ্ভুত ইকোসিস্টেম তৈরি হয়েছে এত গভীরে।
আবার মাঝে মাঝে তিমির মতো বিশাল প্রাণীর মৃতদেহ অনেক বেশি খাদ্যের সঞ্চালন করে এইখানে। হ্যাকফিসের মতো মাছেরা এইসব মৃতদেহের ভেতর থেকে খাওয়া শুরু করে। আর বোনসওয়ানরা হাড় গায়েব করে দেয়। তৃতীয় সমস্যা হলো সমুদ্রের শারীরিক বৈশিষ্ট্য যা বেঁচে থাকা আরো মারাত্মক করে তোলে। এই স্থান হিমশিতল। বেশিরভাগ জায়গায় তাপমাত্রা minus এক এবং চার ডিগ্রি সেট্রিগেটের মধ্যে থাকে । সবচেয়ে খারাপ সমুদ্রের পানির প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে আট টন পরিমান ছাপ যা সমুদ্রে পৃষ্ঠের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি। এ যেন এক ফ্রিজারে পিষে মরবার মতোই অবস্থা। চাপ এবং শীতের এই সংমিশ্রণ প্রাণীর দেহে অদ্ভুত প্রভাব ফেলে। তাদের দেহের কোষগুলো চর্বিযুক্ত ঝিল্লি দ্বারা বেষ্টিত থাকে । এই ঝিল্লি গুলো ঠান্ডায় ফ্রিজের মাখনের মতো শক্ত হয়ে আসতে চায়। কিন্তু কঠিন আস্তরণ দেহে থাকলে প্রাণীরা কম্পন বুঝতে পারবে না। ফলে অবশ্যই দেহের আস্তরণকে নরম রাখতে হবে। তারা কত বছর ধরে এই অবস্থাতে খাপ খাইয়ে নিয়েছে তা কিন্তু একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। সিকিউকাম্বার নামের এই প্রাণীগুলোকে দেখে নিশ্চই তা বুঝতে পারছেন? এখানকার ব্যাকটেরিয়া জিনগুলো দেখায় যে তাঁরা সালফার এবং কার্বন ডাই অক্সাইড খেয়েও বেঁচে থাকতে পারে।
আবার কেউ কেউ মিথেন এবং হাইড্রোজেনের মতো গ্যাসের উপরও নির্ভরশীল. প্রাণের শুরু হয়েছিল কিভাবে তা মারিয়া ট্রেন্সের ব্যাকটেরিয়া আমাদের বুঝতে সাহায্য করতে পারে. অন্য গ্রহের জীবনের অস্তিত্ব কোথায় পাওয়া যেতে পারে তা নির্ধারণ করতেও তারা আমাদের সহায়তা করতে পারে। বৃহস্পতির অন্যতম উপগ্রহ ইউরোপের সাথে এই অঞ্চলের দারুন মিল রয়েছে ইউরোপ আর বরফের নিচে পৃথিবীর চেয়ে দ্বিগুণ পরিমান জল রয়েছে। একটি লোকানো তরল সমুদ্র রয়েছে বলে মনে করা হয়। জেমস ক্যামেরার ম্যালেরিয়া ট্রেন্স থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন যেন অন্য কোন গ্রহ থেকে ঘুরে এলাম আমি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জলের নিচের সব তথ্যও একদিন জানবে মানুষ। জয় করবে সমুদ্রের নিচের রাজ্য. তখন নিশ্চই অনেক দুঃসাহসী অভিযাত্রী মারিয়ানা ট্রেনে ছুটবেন পৃথিবীর গভীরতম স্থানে অবতরণ করা রোমাঞ্চকর অভিযানের হাতছানিতে। শেষে একটা দুঃসংবাদ দিই. আঠারোই সেপ্টেম্বর দু হাজার উনিশ সালে অভিযাত্রী ভিক্টর রেস্কোভার অভিযাত্রায় উঠে এসেছে এই সংবাদ. দূষণের হাত থেকেও রেহাই পায়নি এই গভীর বিন্দু. এখানেও পাওয়া গেছে প্লাস্টিক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন