একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাস মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ভারত তখনও সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে তাঁরা। প্রায় এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে ভারতে। মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী সদর দপ্তর স্থাপিত হয়েছে কোলকাতায়। মুক্তি যোদ্ধারা ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ক্যাম্প করে সেখান থেকে আক্রমণ হানছে পাকিস্তানি সেনাদের উপর.
তেসরা ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শ্যাম টেলিফোন করলেন ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অফ স্টাফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাক জ্যাকবের এর কাছে. মানিক সো জ্যাকব কে বললেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বলুন, পাকিস্তানি বিমান থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের এয়ার ফিল্ড গুলোতে বোমা বর্ষণ করা হয়েছে. ইন্দিরা গান্ধী তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলেন. পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করল ভারত। ছয় ডিসেম্বর প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিল ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়েছে. ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বয়সও হয়ে গেছে পঞ্চাশ বছর. কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে এদেশের অনেক মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধী একটা মনোভাব জাগ্রত হয়েছে তীব্রভাবে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । যারা আমাদের এক কোটি বিপদাপন্ন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, আহার দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছে সেই দেশের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু যথেষ্ট এলার্মী । এটাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই কোনো। কিন্তু এই অবস্থার সৃষ্টি হলো কিভাবে? ভারত আর বাংলাদেশকে এখনো অভিন্ন হৃদয়ের সেই বন্ধুটি আছে? সেই বন্ধুত্বের কতখানি মনের আর কতখানি মুখের? এই সত্যগুলোর উত্তর জানাটা বড্ড বেশি প্রয়োজন। ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ যতই বলুন না কেন যে ভারতের হৃদয় বাংলাদেশ খুব স্পেশ্যাল একটা জায়গা দখল করে আছে। রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আচরণে সেটা কিন্তু আমাদের মনে হয় না কখনো।
আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত বরাবরই বড় ভাইয়ের রোল প্লে করেছে। তাদের আচরণেও একটা দাদাগিরি বজায় ছিল সব সময়. সার্ক বা বিউস টেকের মতো আঞ্চলিক সংগঠনগুলোতে বাংলাদেশ কখনো ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় নি । বরাবরই বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছে তাঁরা। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ বা সে দেশের নাগরিকদের প্রতি ভারতের আচরণ কিন্তু কখনোই প্রসন্ন ছিল না । বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যবর্তী সীমান্তের পরিমান প্রায় চার হাজার একশো কিলোমিটার। গোটা বিশ্বে. যেটা পঞ্চম দীর্ঘতম সীমান্ত সংযোগ । পাকিস্তান বা চীনের সাথেও ভারতের এত লম্বা বর্ডার নেই। ল্যান্ড বর্ডার এগ্রিমেন্টের ধার না ধরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ সবসময় গুলি চালিয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকদের উপর । কখনো no mans land এ আবার কখনো বাংলাদেশের ভেতর থেকে দেশের মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভারতে। চালানো হয়েছে অকথ্য নির্যাতন. সেই নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ মারা গেছেন, কেউ পঙ্গু হয়েছেন. কাঁটাতারে চলেছে কিশোরী ফেলানির লাশ. আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সরব হয়েছে. বিচারের নামে প্রহসনের নাটক সাজিয়ে সবাইকে বেকসুর খালাস দিয়েছে ভারতের আদালত। বিএসএফের হাতে প্রতি বছর এই পরিমাণ বাংলাদেশী নিহত হয়. তার দশ ভাগের এক ভাগ মানুষও পৃথিবীর আর কোন দেশের সীমান্তে অন্য দেশের সেনাদের হাতে গুলি খেয়ে মারা যায় না।
এই যদি হয় বন্ধু রাষ্ট্রের আচরণ সেই বন্ধুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা কিন্তু অমূলক নয় মোটেও। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা শুধু কূটনৈতিক বা আর্থিক নয়, সামাজিক এবং দুই দেশের মানুষের সম্পর্ক, ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক, খাবারের নৈকট্যের সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের একটা আলাদা জোর আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু সেই সম্পর্কের উষ্ণতায়, পানি ঢালার কাজটা ভারত নিজেই করছে। ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় বিজেপি আসার পরে এই ব্যাপারগুলো ঘটেছে খুব বেশি এবং চোখেও পড়ছে।শুধুমাত্র নিজেদের কট্টর হিন্দুত্ববাদী আইডিওলজির কার্যকর করতে সিএএ এবং এনআরসির মতো ধারাগুলো জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে বিজেপি সরকার । আর সেই চাকরি দেওয়ার পথে তারা খুব বাজে ভাবে আক্রমণ করছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে. এটা তো কোনো বন্ধুর কাজ হতে পারে না। ভারতের যখনই বাংলাদেশকে প্রয়োজন হয়েছে বাংলাদেশ নিজেদের উজাড় করে দিয়ে সাহায্য করেছে।সেটা সেটা ফেনী নদীর পানি ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সরবরাহের বেলাতেই হোক কিংবা বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরা আসাম ও মেঘালয় সহ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী পাঠানোর মামলাতেই হোক । কিন্তু এক তিস্তা নদীর পানি কোনো সুরাহা পায়নি বাংলাদেশ আজও । গলার কাঁটার মতো বিঁধে আছে ফারাক্কাবাদ সীমান্ত হত্যার তো কোনো সুরাহাই হচ্ছে না ।বিএসএফের গুলিতে মানুষ মরছে অকাতরে গরু বা মাদক পাচারকারী লেভেল লাগিয়ে সেই হত্যাগুলোকে হালাল করে ফেলা হচ্ছে ।
উনিশশো ছেষট্টি সালে নদী আইনের নিয়মাবলী অনুযায়ী কোনো উজানের দেশ আন্তর্জাতিক নদীর উপর ইচ্ছাকৃত হবে বাঁধ, ব্যারেজ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সুইস গেট নির্মাণ করতে পারবে না. যা ভাটির দেশের জন্য ক্ষতিকর। একইভাবে উনিশশো সাতানব্বই সালে জাতিসংঘের জনপ্রবাহ কনভেনশনেও বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক নদীকে এমন ভাবে ব্যবহার করা যাবে না যাতে তা অন্য দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বা অসুবিধার সৃষ্টি করে । আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে এত আইন থাকার পরেও সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত এর কোন কিছুই মানছে না । আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নদীগুলোর ওপর একের পর এক বাঁধ ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার কারণে বাংলাদেশ তার ন্যায্য তিস্তার পানি কখনোই পায়নি। চুয়ান্নটি অভিন্ন নদীর মধ্যে ভারত বেশ কয়েকটি নদীতেই বাধ ব্যারেজ সহ বিভিন্ন রকম স্থাপনা নির্মাণ করেছে। যা নিয়ে ভারতের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও activist অরুন্ধুতি রায় থেকে শুরু করে সচেতন ভারতীয় ও নাগরিক সমাজও বিভিন্নভাবে আন্দোলনে সংগ্রাম করেছে।
গঙ্গাচুক্তির পঁচিশ বছর হতে চললেও আমরা আমাদের ন্যায্য পানির হিসাব এখনো খুঁজে পাইনি. এক ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গিয়েছে ছোট ও বড় প্রায় বিশটি নদী. নদীমাতৃক দেশ হিসেবে একসময় যে সুনাম বাংলাদেশের ছিল সেটা এখন মিলিয়ে গেছে। বারোশো নদীর জায়গায় এখন কোনো মতে টিকে আছে মাত্র দুশো ত্রিশটি নদী । এছাড়াও মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো ভারত শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে দিয়ে আমাদের খরার মুখে ফেলছে আবার বর্ষাকালে পানি ছেড়ে দিয়ে আমাদের হাজারো গ্রাম পানির নিচে ডুবিয়ে দিচ্ছে । যার কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছরই বর্ষাকালে ভয়ানক বন্যা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার শুষ্ক মরশুমে দেখা দিচ্ছে মরুকরণ। ভারতের নাগরিকত্ব আইনে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতোই সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়. আসামের নাগরিকপঞ্জিতে প্রায় বারো লক্ষ বাংলাদেশি ভারতীয়র গায়ে বিদেশি তকমা লাগানো হয়েছে. ভারত এটাকে তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বলেছে । সরকারিভাবে বাংলাদেশ তা মেনেও নিয়েছে. কিন্তু এই বিদেশীরা কোন দেশ থেকে ভারতে এসেছে সেই প্রশ্ন ডেমোক্রেসির তরবারির মতো বাংলাদেশের মাথার উপর ঝুলে থাকছে সবসময়। সব চেয়ে যে আহত করেছে বাংলাদেশের মানুষকে, তা হচ্ছে ভারতীয় উচ্চ নেতৃত্বের অবস্থান থেকে কথিত বাংলাদেশি বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে অপমান কর বাক্য প্রয়োগ. বিজেপির নেতারা নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ এবং এদেশের মানুষকে কটু বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছে. বন্ধুর প্রতি বন্ধুর আচরণ কোনোভাবেই এমনটা হতে পারে না ।
ভারত এই ইস্যুতে তার চিরশত্রু পাকিস্তানের কাতারেই নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় বিশ লাখ পর্যটক ভারত সফরে যান. তাদের ভিসা দেয় ভারতের মিশনগুলো।ভারতীয় সরকার এই বিপুল সংখ্যক ভিসা প্রদানকে বিশাল এক বদান্যতা রূপে উপস্থাপন করে। অথচ এই পর্যটকরা যে কত বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর ভারতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত করে. সেটার উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। ভারতের স্বাস্থ্য আর পর্যটন এই দুই সেক্টরে বাংলাদেশি নাগরিকদের অবদান যে অনস্বীকার্য সেটা কোভিডের সময় দেখা গেছে। বাংলাদেশী ক্রেতা নেই বলে হাহাকার করেছেন কলকাতার নিউ মার্কেটের বিক্রেতারা। বাংলাদেশ থেকে কথিত বেআইনি অনুপ্রবেশ ভারতীয় রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক পর্যন্ত সবারই খুব প্রিয় একটা বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশ যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতীয় নাগরিকের জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রেও এবং বিশ্বে ভারতের রিমিট্যান্সের চতুর্থ বৃহত্তম উৎসব । এর উল্লেখ কোথাও হয় না বললেই চলে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টর এবং মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চ পদে আসীন ব্যক্তিদের অনেকেই ভারতীয়. তাঁরা নিজ যোগ্যতায় সেসব পদে চাকরি পেয়েছেন সত্য।কিন্তু এদেশ থেকে উপার্জিত টাকা তাঁরা যে নিজেদের দেশে পাঠাচ্ছেন সেই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা হয় না. আলোচনা ঘুরিয়ে ফেলা হয়. বাংলাদেশ থেকে ভারতে কাজ করতে যাওয়া মানুষগুলোর উদাহরণ দিয়ে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য যেমন ত্রিপুরা, আসাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর, অরুণাচল। এসব জায়গায় বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলাদের উৎপাত ছিল চোখে পড়ার মতো। ভারতীয় সেনাদের সাথে নিয়মিতই তাদের সংঘর্ষ হতো অনেক সেনা মারা পড়তো তাদের হামলায়। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো যে অস্ত্র সাহায্য পেত সেগুলো চীন বা মিয়ানমার থেকে আসতো। বাংলাদেশের ভূমি যেন কোনোভাবেই ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করতে পারে কেউ সেটা নিশ্চিত করা হয়েছে।আসামের উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে আটক করে ভারতের হাতে হস্তান্তর করা হয়ে ছিল।
এত কিছু পাওয়ার পরেও বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরণ কিন্তু সদয় হয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার থেকে ধেয়ে আসা স্মরণার্থীর চাপে বাংলাদেশ যখন হিমশিম খাচ্ছিল তখন কিন্তু ভারত আমাদের সাথে বন্ধুর মত আচরণ করে নি। আন্তর্জাতিক ফোরামে তারা মায়ানমারের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেনি । মুখ বন্ধ করে রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ।ভারতের কাছ থেকে বঙ্গোপসাগরে যে বিশাল আয়তনের সমুদ্রসীমা বাংলাদেশ বুঝে পেয়েছে সেই অধিকারও কিন্তু আন্তর্জাতিক সমুদ্র আদালতে গিয়ে আদায় করতে হয়েছে ।
বন্ধুর প্রতি বন্ধুর চাহিদা কি থাকে বলুন তো? বিপদে সাহায্য পাওয়া যাবে, বন্ধুত্বের খাতিরে প্রায়োরিটি লিস্টে ওপরের দিকে থাকা যাবে. তাইতো? অথচ মুখে যাই বলুক. ভারতের প্রায়োরিটি লিস্টে বাংলাদেশের অবস্থান কিন্তু খুব বেশি ওপরে ছিল না কোনদিনই। এই করোনাকালের কথাই ধরুন। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে অক্সফোর্ড অ্যাসট্রোজেনকার তিন কোটি টাকা কেনার চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। এর বাইরেও ভারত সরকার বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে বত্রিশ লক্ষ ডোজ উপহার দিয়েছিল। কিন্তু গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভারত সরকার সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত সব টিকা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়. প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তিন কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশ পায়নি. বাধ্য হয়ে চীনের সিনো ফর্মের সঙ্গে নতুন চুক্তিতে যেতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এই যে মহামারীর দুঃসময়ে বন্ধুর কথা না ভেবে শুধু নিজের কথা ভাবা। এটা তো কোন বন্ধুর কাজ হতে পারে না। তাতে বন্ধুত্বের অমর্যাদা করা হয়। এর আগেও নানা সময় পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলেছে ভারত। ভারত থেকে প্রতি বছর আট পয়েন্ট দুই বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পূর্ণ বাংলাদেশে আসে। দক্ষিণ এশিয়ায় আর কোন দেশে এত বেশি ভারতীয় পণ্য রপ্তানি হয় না।গোটা পৃথিবী মিলেই এর চেয়ে বেশি অঙ্কের ভারতীয় পূর্ণ রপ্তানি হয় শুধুমাত্র আমেরিকায়। অন্যদিকে ভারতে প্রতি বছর মাত্র এক দশমিক দুই ছয় বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি হয়। দুই দেশের রপ্তানির পার্থক্যটাই বিভাজনের দেয়ালটা ফুটিয়ে তোলার জন্য স্পষ্ট। মনে রাখতে হবে গত কয়েক বছর ধরেই বৈধভাবে ভারতীয় গরু আমদানি করছে না বাংলাদেশ। গরু বাদ দিয়েই এই বিশাল অঙ্কের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে পারছে ভারত। কিন্তু সেই পরিমান সুবিধা বা মর্যাদা পাওয়া যাচ্ছে না ভারতের কাছ থেকে। এমন অনেক পণ্য যা বাংলাদেশ বিদেশে রপ্তানি করে সেগুলো ভারত অন্য দেশে আমদানি করছে । এই করোনা কালেও বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারত তাদের পণ্য বাংলাদেশে পাঠালেও করোনা ভাইরাসের অজুহাতে বাংলাদেশের পণ্য ভারতে ঢুকতে দিচ্ছে না। এর প্রতিবাদ স্বরূপ বাংলাদেশের সিএনএফ এজেন্টরা সীমান্তে ভারতের পণ্য খালাস বন্ধ করে দিয়েছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে ভারত, বাংলাদেশকে অনেকটাই টেকেন ফর গ্র্যান্ডের হিসেবে নিয়েছিল। কারণ ভারতীয় বলয়ের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ কখনো কূটনৈতিক অবস্থান নেবে এমনটা সম্ভব নয়. ভারতও এটা জানতো.
কিন্তু ভারতের বিপক্ষে কূটনৈতিক অবস্থা না নিয়েও বাংলাদেশ যখন নির্ভরতা কমিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হয়েছে। একই সাথে চীন এবং আমেরিকা এই দু দেশকেই হাতে রাখছে. ওদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাততে চাইছে. তখনই ভারতের টনক নড়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব থেকে শুরু করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি উড়ে এসেছেন বাংলাদেশকে মধুর ভাষায় তারা বর্ণনা করেছেন এই দুই রাষ্ট্র কত ভালো বন্ধু । আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের যেখানটায় বাংলাদেশের অবস্থান ভূরাজনৈতিক দিক থেকে সেখানে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ তাই চীন চায় আমাদের হাতে রাখতে। আমেরিকা চায় আমাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকুক। আর ভারত চায় অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ শুধু তাকেই তোয়াজ করুক। ভারত এই অঞ্চলের পরশক্তি হতে চায়. সেই চাওয়ার পথে বাকিরা কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে নিরন্তর। চীন বা পাকিস্তানের সাথে তো ভারতের সরাসরি শত্রুতা। শ্রীলঙ্কা বা নেপালের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক আগের মতনই. নেই সেই প্রভাব প্রতিপত্তিও.
এই অঞ্চলে ভারতের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশী আছে, যারা কিনা এখনো চীনা বলয়ের ভেতরে ঢুকে পরেনি। হতে চাইলে বাংলাদেশকে ভারতের লাগবেই। আবার দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার পথে হাঁটতে গিয়ে ভারতকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয় বাংলাদেশের পক্ষে। এই দুই দেশ একে অন্যের পরিপূরক। তাই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও ফিফটি ফিফটি হোক. হোক পারস্পরিক মর্যাদা আর সম্মানের. পাশাপাশি দুই দেশকেই নিশ্চিত করতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান নাগরিকের জীবন ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা. চলতে হবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতে হাত ধরে. এক সমান্তরালে। যেই বন্ধুত্ব একটা রাষ্ট্রের জন্মের সময় সাহায্য আর সহমর্মিতার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল সেটাকে তিক্ততা কিংবা বৈরিতার দিকে নিয়ে যাওয়াটা দুই দেশের জন্যই সমান লোকসানের ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন