বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মুদ্রা হলো মার্কিন ডলার. সারা বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলার ব্যবহার করা হয়. বিশ্বের মোট অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রায় নব্বই শতাংশ হয়ে থাকে মার্কিন ডলারের মাধ্যমে. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য মার্কিন ডলার প্রায় অপরিহার্য. আমেরিকান ডলারের বিকল্প বা সমকক্ষ আর কোনো মুদ্রা নেই বললেই চলে. বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মার্কিন ডলারের এতো দাপট কিভাবে তৈরি হলো সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ?
কারেন্সি বা মুদ্রাকে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়. কমোডিটি কারেন্সি , রিপ্রেজেন্টেটিভ কারেন্সি এবং ফিয়াট কারেন্সি. কমোডিটি কারেন্সি হল সেই ধরনের অর্থ যার কোন অন্তর্নিহিত মূল্য আছে. যেমন স্বর্ণ বা রৌপ্যের নিজস্ব মূল্য আছে. প্রাচীনকাল থেকে স্বর্ণ ও রৌপ্যকে সরাসরি বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হতো. স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্যমুদ্রাকে গলিয়ে ফেললেও এর মূল্য হ্রাস পায় না. এজন্য স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্যমুদ্রা এগুলো হলো কমোডিটি মানি. মানব ইতিহাসের বড় একটি সময় জুড়ে অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য সোনা রুপা, তামা বা তামাক পাতা, কমোডিটি কারেন্সি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে. কিন্তু পরবর্তীতে প্রকৃত মূল্যবান বস্তুর বিকল্প হিসাবে representative currency এর যাত্রা শুরু হয়.
কাগজে মুদ্রার কোনো অন্তর্নিহিত মূল্য নেই. কার্যত এগুলো কাগজের টুকরো ছাড়া আর কিছুই নয়. কিন্তু এই কাগজে মুদ্রা গুলো কোনো মূল্যবান ধাতু বিশেষ করে স্বর্ণের সাথে সম্পর্কিত. কাগজে মুদ্রার মান কোনো রাষ্ট্রের স্বর্ণ মজুদের উপর নির্ভর করে. সর্বপ্রথম চীনে কাগজে নোটের প্রচলন হয়ে ছিল. কিন্তু ইউরোপে কাগজে মুদ্রার প্রচলন ঘটার পর থেকে তা ক্রমশ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে. ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত রাষ্ট্র স্বর্ণমান বা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড গ্রহণ করে. এই ব্যবস্থায় স্বর্ণের মুল্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় এবং যেকোনো সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ কাগজে মুদ্রার পরিবর্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ পাওয়া যেত. তখনো পর্যন্ত টাকার মান নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না. কিন্তু ঝামেলা তৈরী হয় যখন ফিয়াট কারেন্সির আবির্ভাব ঘটে. এই মুদ্রাও কাগজে নোটের মাধ্যমে প্রচলিত.
কিন্তু এই নোটের সাথে বাস্তবে কোনো মূল্যবান ধাতু বা স্বর্ণের কোনো সম্পর্ক নেই. ফিয়াট মানির ক্ষেত্রে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক তাদের চাহিদা মতো টাকা ছাপিয়ে অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে. বর্তমান কালের অধিকাংশ আধুনিক মুদ্রাই ফিয়ার্ড কারেন্সি. এমনকি বহুল আলোচিত এই আমেরিকান ডলার থেকে শুরু করে বাংলাদেশি টাকাসহ প্রায় সবই ফিয়েট কারেন্সি. উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেন ছিল বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক পরা শক্তি. তাদের স্বর্ণের মজুদ ছিল সবচেয়ে বেশি এবং লন্ডন ছিল বিশ্ব banking এর কেন্দ্র. এই জন্য ব্রিটিশ মুদ্রা pound starling ছিল সে সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা. তাই বিশ্ব বানিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ pound ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতো. আঠারোশো সত্তরের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়. এরপর বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় দেশগুলো যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য ইচ্ছামতো টাকা ছাপাতে শুরু করে.
তাদের স্বর্ণের মজুদের ভিত্তিতে যে পরিমান মুদ্রা ছাপানো সম্ভব ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে তারা নোট ছাপাচ্ছিল. অন্যদিকে যুদ্ধের প্রথম তিন বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে. সেই সময় তারা ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে অস্ত্র ও যুদ্ধের রসদ বিক্রি করে আমেরিকার অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলে. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটেন সহ অধিকাংশ দেশ তাদের স্বর্ণমান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়. কারণ তখন তাদের টাকার মান দেশের মজুদ স্বর্ণমানের উপর নির্ভরশীল ছিল না. এই পরিস্থিতিতে দেশগুলোর মুদ্রা ব্যবস্থা চাহিদা ও যোগানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে. আর তখন থেকেই ফিয়াট কারেন্সি বা প্রকৃত মূল্যহীন কারেন্সি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পরে. ইউরোপের অর্থব্যবস্থায় পরিবর্তন আসলেও মার্কিন ডলার তখনও ফিয়াট কারেন্সিতে পরিণত হয়নি. তখনো পর্যন্ত আমেরিকান ডলার স্বর্ণমানের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ ছিল. যেসব দেশ ফিয়াট মানের প্রচলন ঘটিয়ে ছিল. তারা তাদের স্বর্ণের মজুদ বৃদ্ধি করে মুদ্রার প্রকৃতমান ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়. অন্যদিকে তখনকার দিনে আমেরিকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক দেশ. এবং মার্কিন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ছিল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য.
সে কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পাউন্ডের বদলে মার্কিন ডলার অগ্রাধিকার পেতে থাকে. মার্কিন ডলারকে অধিক নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে বিভিন্ন দেশ তাদের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবেও ডলার সঞ্চয় করতে থাকে. এক পর্যায়ে অধিক ব্যবহারের ফলে মার্কিন ডলার গ্লোবাল কারেন্সি বা বৈশ্বিক মুদ্রা হিসাবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়. এর প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বর্ণের মজুদ বৃদ্ধি করতে শুরু করে. যুক্তরাষ্ট্র তখন তাদের রপ্তানি করা জিনিসপত্রের বিনিময়ে স্বর্ণ ছাড়া অন্য কোন কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাই. এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণের মজুদ বাড়তে থাকে. বিপরীতে অন্য রাষ্ট্রগুলোর স্বর্ণের মজুদ কমতে থাকে. এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে অনেকটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে. প্রথম আড়াই বছর যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল. এবং যুদ্ধরত দেশগুলোর কাছে প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে. যথারীতি এই সময়েও যুক্তরাষ্ট্র তার রপ্তানিকৃত পণ্যের বিনিময়ে স্বর্ণ ছাড়া অন্য কোন কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাই. এই নীতির কারণে তাদের স্বর্ণমজুদ ফুলে-ফেঁপে ওঠে. এমনকি উনিশশো-সাতচল্লিশ সালে বিশ্বের মোট মজুদকৃত স্বর্ণের সত্তর ভাগই ছিল আমেরিকার কাছে.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমেরিকার জন্য এক ধরনের আশীর্বাদ হয়ে আসে. এই বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীতে আমেরিকার অবস্থান চিরদিনের মতো বদলে দেয়. যুদ্ধের পরে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মতো পরাশক্তি গুলো অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়. কারণ তাদের উপার্জনের প্রধান উৎস তাদের উপনিবেশ গুলো একে একে স্বাধীন হয়ে যাচ্ছিল. তখন শুধুমাত্র আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়. বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই অন্যান্য রাষ্ট্র অনুধাবন করতে পেরেছিল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র একছত্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে. যুদ্ধ পরবর্তী অর্থনীতি যাতে স্থিতিশীল থাকে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য উনিশশো চুয়াল্লিশ সালে মিত্র পক্ষের চুয়াল্লিশটি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যামসা রঙ্গরাজ্যের বিটোন উডস নামক অবকাশ যাপন কেন্দ্রে আলোচনার জন্য সমবেত হয়. দেশগুলোর প্রতিনিধিরা একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে. যা বিটোন উডস চুক্তি নামে পরিচিত. এই চুক্তি বিশ্ব অর্থনীতির মেরুদন্ডে পরিণত হয়.বিটোন উডস চুক্তির মাধ্যমেই স্বর্ণকে পাশ কাটিয়ে মার্কিন ডলারকে আনুষ্ঠানিকভাবে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে গ্রহণ করা হয়. এই সময় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে মার্কিন ডলারের সঙ্গে যে সংযোগ ছিল সেটি বজায় থাকবে এবং আগের মতোই বিনা বাধায় মার্কিন ডলারকে ইচ্ছামতো স্বর্ণে রূপান্তর করা যাবে. বিটোন উডস চুক্তির ফসল হিসেবেই বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা IMF প্রতিষ্ঠিত হয়. এই আন্তর্জাতিক সংস্থা দুটি বিশ্বব্যাপী আমেরিকার প্রভাব বলয় সৃষ্টি করতে প্রধান ভূমিকা পালন করে. উনিশশো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো এবং জাপান বিশ্বযুদ্ধের দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়. তখন তারা তাদের মজুদকৃত মার্কিন ডলারের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আবারও স্বর্ণ কিনতে শুরু করে. এর ফলে মার্কিন স্বর্ণ মজুদ ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে. সেই সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের পেছনেও আমেরিকার অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়. সেই সাথে উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসন গ্রেট সোসাইটি নামে এক বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে. যার উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার শিক্ষা, নাগরিক অধিকার, স্বাস্থ্য খাত এবং অনুন্নত অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন করা. এই প্রকল্পের ব্যয় মেটানোর জন্য মার্কিন সরকার বিপুল পরিমাণে টাকা ছাপাতে শুরু করে. এর ফলে মার্কিন ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের সামঞ্জস্য রাখা আর সম্ভব হয় না. উনিশশো একাত্তর সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিকসন বিশ্ব অর্থনীতিকে এক বিশাল ধাক্কা দেন. যেটি নিকসন শক নামে পরিচিত. তিনি ঘোষণা করেন যে এখন থেকে আর মার্কিন ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের কোনো সংযোগ নেই. অর্থাৎ এখন থেকে কোনো দেশ চাইলেই মার্কিন ডলারের বিনিময়ে স্বর্ণ কিনতে পারবে না. তার মানে মার্কিন ডলারও তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুদ্রাগুলোর মতো ফিয়াট কারেন্সিতে পরিনত হয়. মার্কিন ডলার যখন ফিয়াট কারেন্সিতে পরিণত হলো তখন অন্য দেশগুলো কেন মার্কিন ডলারকে ত্যাগ করলো না? এখনো পর্যন্ত কেন ডলারকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে? এর কারণ হলো মার্কিন ডলারকে ত্যাগ করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন একটি রিজার্ভ মুদ্রার প্রয়োজন হতো. কিন্তু যখন নিকশন শক কার্যকর হয় তখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি. তখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার মতো অন্য কোনো দেশ ছিল না. ফলে মার্কিন ডলারের মানের পতন ঘটলেও তাদের আধিপত্য কে কোনো বাধারই সম্মুখীন হতে হয় নি. তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর বিরুদ্ধে ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে. বিভিন্ন সময়ে ইরান, চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র. এর ফলে দেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করা অনেক কঠিন হয়েছে. আমেরিকার এই একাধিপত্য বন্ধ করতে অনেকেই ত্রিপ্ট কারেন্সিকে বৈশিক মুদ্রা হিসাবে গ্রহণের প্রস্তাব করছেন. তৃপ্ত কারেন্সি হল এক ধরনের ডিজিটাল মুদ্রা. যা কোনো দেশের সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন