মানুষ তার অনেক কিছু নিয়েই গর্ব করে । বিজ্ঞান থেকে শুরু করে নাম , বর্ণ, জাতি, শ্রেণী , সিনেমা , গল্প , কবিতা ইত্যাদি নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই । এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছে মাত্র একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে. সেই বিষয়টিকে মানুষ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়. আর তা হল বুদ্ধিমত্তা. সাধারণত বুদ্ধিমত্তাকে আমরা শক্তির মতো কোনো একটি বৈশিষ্ট্য বলে মনে করি. কিন্তু যখনই আমরা একে সঙ্গায়িত করার চেষ্টা করি, যে বুদ্ধিমত্তা কি? তখন সেটা বেশ ঘোলাটে হয়ে আসে. এক কথায় বলতে গেলে বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে সমস্যা সমাধানের জন্য এক ধরনের পদ্ধতি বা মেকানিজম যা টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত মানুষকে যে সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে হতো। যেমন খাবার সংগ্রহ ও আশ্রয় খোঁজা প্রজননের জন্য সঙ্গী খোঁজার প্রতিযোগিতা কিংবা শিকারি প্রাণী থেকে পালিয়ে বাঁচার কৌশল আবিষ্কার করা প্রভৃতিকে বোঝায়.
বুদ্ধিমত্তা কোনো একক বিষয়. এর মধ্যে রয়েছে জ্ঞান আহরণের সক্ষমতা. বিভিন্ন বিষয়ে শেখার দক্ষতা, সৃজনশীলতার, কৌশল উদ্ভাবনের ক্ষমতা এবং জটিল বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তা করার সামর্থ্য । এটা নিজেকে প্রকাশ করে বিভিন্ন রকমের আচরণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে । যেমন বিভিন্ন মাত্রার চেতনা এবং বিভিন্ন ধরণের শিক্ষার প্রতি প্রবৃত্তিগত বা প্রকৃতিগত প্রতিক্রিয়া। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা কিভাবে শুরু হয়েছে বা এর সংজ্ঞা কি তা নিয়ে সকল বিজ্ঞানী কিন্তু একমত্ নয় । ব্যাপারটা আসলে আরো জটিল কারণ বুদ্ধিমত্তা চেতনার সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেহেতু চেতনা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে খুবই উপকারী ।সুতরাং বুদ্ধিমত্তা বলতে আসলে কি বোঝায় সেটা ঠিক পরিষ্কার নয় । একে অনেক ধরনের দক্ষতা ও কৌশলের সমষ্টি ভাবতে পারি. বা একে একটা টুল বক্স বা যন্ত্রপাতির বাক্স ভাবতে পারি। যার মধ্যে একেবারে মৌলিক যন্ত্রপাতিগুলো রয়েছে. এই মৌলিক যন্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে তথ্য সংগ্রহ ও তার স্মৃতিতে ধারণ করার ক্ষমতা এবং এবং তা ব্যবহার করে বিভিন্ন বিষয় গুলি শিখতে পারার ক্ষমতা।
পৃথিবী সম্পর্কিত নানান তথ্য বিভিন্ন এনজিএর সাহায্যে যেমন চোখ, কান, নাক, স্বাদ বা স্পর্শর মধ্য দিয়ে পুনধাবন করা হয়. একই সাথে এই ইন্দ্রিয়গুলো বাহ্যিক পরিবেশের সাথে আমাদের যথাযথ প্রতিক্রিয়া প্রকাশে সাহায্য করে. জীবিত প্রাণীকে নিজের দেহের অবস্থা সম্পর্কে সার্বক্ষণিক অবগত থাকতে হয়. ক্ষুধা, ক্লান্তি, নানান চাহিদার বিষয়ে সচেতন থাকতে হয়. তথ্য হচ্ছে সকল জীবিত প্রাণীর জন্য সকল কর্মের ভিত্তি। তথ্য ছাড়া তার টিকে থাকা নির্ভর করে পরিবেশের দয়ার ওপরে। যেহেতু সঠিক তথ্য ব্যতীত সে যথাযথ প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া দেখাতে অক্ষম। তথ্য অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে যদি তার সংগ্রহ ও ধারণ করে রাখা যায়। সুতরাং দ্বিতীয় মৌলিক যন্ত্রটি হচ্ছে আমাদের স্মৃতি. স্মৃতি হচ্ছে তথ্য সংগ্রহ ও তার ধারণ ও স্মরণ করতে পারার ক্ষমতা. যাতে করে একই তথ্য তাকে বারবার সংগ্রহ করতে না হয় এবং একই জিনিস বারবার শিখতে না হয়. এই স্মৃতি হতে পারে কোন ঘটনা সম্বলিত কোন স্থানকে ঘিরে বা কোন সঙ্গী বা সমাজ সম্পর্কিত আবার এমনও হতে পারে।
কোন ব্যবহার বা আচরণগত স্মৃতি যেমন শিকার কৌশল বা কোন কিছু নির্মাণ করতে পারার পন্থা আবিষ্কার যা কোন প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য রপ্ত করে। কিছু আচরণ বা দক্ষতা অর্জনের জন্য বারবার অনুশীলন করতে হয় যাতে করে তা সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করা যায়. যেমন উড়তে পারা বা সাঁতরানো. এই অনুশীলনের মাধ্যমেই কোনো দক্ষতা অর্জন করা যায়. অর্থাৎ অনেক গুলো গুলো চিন্তা বা কাজ একটি নির্দিষ্ট ধারায় করতে পারার সক্ষমতা তৈরি হয়. এই তিনটি মৌলিক যন্ত্র বা ক্ষমতা সবচেয়ে নির্ভর প্রাণীটিকেও অবাক করার মতো বুদ্ধিদীপ্ত কাজ করতে সাহায্য করে. যেমন এককোষী স্লাইন মন, যা মূলত একটা বৃহৎ স্লাইম কোষ. এমন সব ব্যবহার প্রদর্শন করে যার সাথে সরল মস্তিষ্কের প্রাণীদের আচরণের মিল আছে। যদিও এই এককোষি স্লাইমের কোন মস্তিস্ক নেই। যখন কোন গোলক ধাঁধার মতো স্থানের এক কোনে খাবার আর আরেক কোনে এই এককোষি স্লাইমকে রাখা হয়। এটি এর চারপাশের পরিবেশে নিজের শরীরের অংশ ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পথ খুঁজতে থাকে এবং খাবারের কাছে পৌঁছায় যে বাধা সমূহ সেগুলো প্রথমবার চিহ্নিত করে দ্বিতীয়বার এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে একসময় খাবারের কাছে পৌঁছতে সফল হয়. অন্ধভাবে চলাচল করে এক জায়গায় আটকে না গিয়ে এটি পরিবেশের সাথে নিজের আচরণ খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমে সময় এবং পরিশ্রম বাঁচায়. তবে এই আচরণ তাকে প্রকৃতিগত অর্থাৎ এটা এমন কিছু না যা তারা পরে শিখে বরং জন্ম থেকেই তাদের মধ্যে থাকে. তাই বিজ্ঞানীরা একে বুদ্ধিমত্তা বলবে কি বলবে না সে ব্যাপারে একমত নয় । যদিও এরা স্লাইম মোল কে কিছু সুবিধা প্রদান করে. মৌমাছিরা বরং এই ক্ষেত্রে আরো উপযুক্ত উদাহরণ. বিজ্ঞানীরা মৌমাছিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে একটা রঙিন বলকে একটা নির্দিষ্ট গর্তে ফেলার জন্য. যা করলে সে পুরস্কার হিসেবে চিনির টুকরো পায়. অর্থাৎ যদিও এই আচরণ তার প্রকৃতিগত নয় তারা এই ধরনের আচরণ শিখতে পারে এবং সময়ের সাথে তাতে পারদর্শীও হয়ে উঠতে পারে ।
আরো কঠিন সমস্যা সমাধানের জন্য দরকার হয় আরো বেশি দক্ষতার এবং আরো সূক্ষ্ম যন্ত্রের। জটিল গঠন সম্পন্ন প্রাণীরা মৌলিক যন্ত্র বা ক্ষমতাগুলোর উপর ভিত্তি করে আরো অনেক ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারে. তারা সব ধরনের যোগাযোগ, সংযোগ এবং কৌশল বা যান্ত্রিক দক্ষতা মনে রাখতে পারে. আমরা এটাকে বলতে পারি জ্ঞানের লাইব্রেরি। এইসব কৌশল এবং দক্ষতা ছাড়াও আরও একটা আকর্ষণীয় ক্ষমতা আমাদের আছে সেটা হচ্ছে সৃজনশীলতা. সৃজনশীল হওয়ার মানে হচ্ছে আপাত সম্পর্কহীন বিষয়াবলী থেকে সম্পূর্ণ নতুন কিছু এবং মূল্যবান কিছু তৈরি করা. বুদ্ধিমত্তার প্রেক্ষিতে এর মানে হচ্ছে নতুন এবং ব্যতিক্রমী সংযোগ তৈরি করা। দক্ষতার সাথে স্মৃতিতে ধারণকৃত তথ্য একত্রিত কোনো সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা ।সৃজনশীলতার আর একটি দিক হচ্ছে কোনো কাজে নতুন পদ্ধতি বা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারার ক্ষমতা। যেমন কোনো প্রাইমেট কাঠি ব্যবহার করে গাছের ভেতর থেকে পিঁপড়া ধরে আনে বা অক্টোপাস নারিকেলের খোল জোগাড় করে এর ভেতর লুকিয়ে থাকে । \
ভবিষ্যতে কোনো সমস্যার জন্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করে রাখা সমস্যা সমাধানের পথে আরো একটা জটিল এবং উন্নত ধরনের কৌশলের সাথে যুক্ত । যা হচ্ছে পরিকল্পনা বা প্ল্যানিং। প্ল্যানিং মানে হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো কি হবে তা নির্ধারণ করা এবং সেগুলো নিয়ে একটা পরিকল্পনা তৈরি করা এবং যখন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি বা নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয় সেগুলো পরিকল্পনার সাথে খাপ খায় কিনা তা খতিয়ে দেখা। এই ধরনের বুদ্ধিভিত্তিক আচরণের একটা উদাহরণ হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য খাবার সংগ্রহ করে রাখা. এটা কাঠবিড়ালিদের ক্ষেত্রে একটা প্রবৃত্তিগত আচরণ. কিন্তু যদিও খাবার লুকোনোটা তাদের প্রবৃত্তিগত. এই লুকোনোর কাজটির জন্য তাদের বুদ্ধির ব্যবহার করতে হয়. কাঠবিড়ালিরা প্রতিটি কাঠবাদামের ওজন এবং আকৃতি পরীক্ষা করে হিসাব করে কি পরিমান সময় এবং পরিশ্রম প্রয়োজন হয় সেগুলো লুকানোর জন্য এবং এতে তার কতটুকু লাভ হবে প্রতিটি কাঠবাদাম থেকে যেমন একটু নষ্ট এবং কমপুষ্টির বাদামগুলো আগে খেয়ে ফেলা এবং যেগুলো এখনও পরিপক্ক হয়নি সেগুলো লুকিয়ে রাখা. এমনকি কার্ঠবিরালি বাদাম লুকোনোর অভিনয় করে যখন সে বুঝতে পারে অন্যরা তাকে দেখছে.
এই খালি বাদামের খোল গুলো দিয়ে সে শত্রুকে বিভ্রান্ত করে আসল বাদামগুলো অন্য জায়গায় লুকায়. এটা বেশ অগ্রসর ধরনের পরিকল্পনা. কারণ কাউকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রথমে এটা অনুধাবন করতে হয় যে তার মত আরও কেউ আছে যে সে একই জিনিস চাই. সমস্যা যত জটিল তত বেশি সরঞ্জামের সমন্বয় প্রয়োজন হয় তা সমাধানের জন্য. তাই যত বেশি সরঞ্জাম থাকবে তত সহজে জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান করা যাবে. আবার মানুষ ভিন্ন দিক থেকে বিবর্তিত হয়েছে এবং বিপুল রকমের বুদ্ধি বৃত্তিক সরঞ্জাম অর্জন করেছে. সেই সাথে আমরা আরো একটা বিষয় অর্জন করেছি তা হলো কালচার বা সংস্কৃতি । কোনো মানুষ একক ভাবে রকেট বা পার্টিকুলার এক্সেলারেটর তৈরী করতে পারতো না ।
কিন্তু একত্রে কাজ করতে পারার ক্ষমতার জন্য এবং যুগের পর যুগ ধরে মানুষের অর্জিত জ্ঞান বিতরণ করতে পারার জন্য আমরা এমন সব সমস্যার মোকাবিলা করতে পারি যেগুলো একার পক্ষে সম্ভব হতো না. এর ফলে আমরা পৃথিবীকে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলতে পেরেছি. একই সাথে অবশ্য আমরা নতুন সমস্যাও সৃষ্টি করেছি. যেমন দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন এবং এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স. এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের বর্তমানে বেঁচে থাকার চিন্তা পার করে দুমুর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে. আমাদের সরঞ্জামের বাক্সটা আছে. শুধুমাত্র একে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন