প্রযুক্তির দীর্ঘ পথ চলায় উন্নত বিশ্ব এখন ফাইভ জির পথে. প্রযুক্তি বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও সে পথে হাঁটছে. স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ফাইভ জি যে চালু করতে চায় সরকার. স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে দু হাজার একুশ সালের প্রথম প্রান্তিকে ।
কেউ বলছেন four G কেউ বলছেন four point five G. কেউ বা আবার আগ বাড়িয়ে four point nine G বানিয়ে দিচ্ছেন. অর্থাৎ প্রায় five G. অথচ internet speed এর বেলায় লবডঙ্কা. নামে four G কাজের three GO নয়. এমন দশা বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর ইন্টারনেট সার্ভিসে. ফোর্থ জেনারেশন বা চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা আমাদের দেশে available থাকলেও গ্রাহক হিসেবে যে স্পিড আমরা পাই সেটা বলতে গেলে লজ্জায় মুখ লুকাতে হবে.
গত জুন মাসে ইন্টারনেটের গতি মাপার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওক্লা একটা জরিপ করেছিল. স্পিড টেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স নামের সেই জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের একশো সাঁইত্রিশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান. একশো পঁয়ত্রিশ নম্বরে. বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ভেনিজুয়েলা. কিন্তু বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গতির এমন বেহাল দশার কারণ কি?
কেন আফ্রিকার দরিদ্র দেশ হিসাবে পরিচিত ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার চাইতেও খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের. গত এক বছরে করোনার কারণে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যান্ড উইথের ব্যবহার বেড়েছে দুই গুণ. কিন্তু এর সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা অর্থাৎ তাদের বেতার তরঙ্গের ব্যবহার সেই অনুপাতে বাড়েনি। মূলত এই কারণেই গ্রাহকরা তাদের কাঙ্খিত ইন্টারনেটের গতি পাচ্ছেন না। একটি মোবাইল ফোন তার নেটওয়ার্ক এর সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ স্থাপনের জন্য যে সময় নেয় সেটির নির্দেশক লেটেন্সি ও জিটার । মিলি সেকেন্ড স্কেলে এই সময় যত বেশি লাগবে ইন্টারনেটের গতি ততই কম হবে। বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গড় লেটেন্সি ও জিটার যথাক্রমে তেতাল্লিশ ও সাতচল্লিশ মিলি সেকেন্ড । যদিও জানুয়ারি মেজারমেন্টে লিটেন্সিও জিটার ছিল আটত্রিশ ও ঊনচল্লিশ মিলি সেকেন্ড করে. অর্থাৎ এই ছয় মাসে বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি কমেছে. বাড়েনি.
বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরগুলো কয়েক বছর ধরেই four G speed এ internet সেবা দিয়ে আসছে বলে দাবি করছে. এমনকি খুব শিগগিরই তারা ইন্টারনেটের নতুন প্রযুক্তি ফাইভ জির সেবা নিয়ে আসবে এমন কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে. কিন্তু সত্যিকারের ফোরজি স্পিডের সঙ্গে বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর ফোরজি স্পিডের বিস্তর ফারাক. অপারেটররা তাদের রংচঙ্গে বিজ্ঞাপন ও প্রচরণায় দেশব্যাপী নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগের দাবি করলেও মাঝে মাঝে রাজধানী ঢাকার ভেতরেই সংযোগ পেতে ঝামেলা পড়েন গ্রাহকরা । আর ঢাকার বাইরের জেলাগুলো বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চল এবং গ্রাম অঞ্চলের অবস্থা সে তো আরো শোচনীয়। ঘনঘন কানেকশন লস্ট, কল ড্রপ, ব্রাউজিং এবং ডাউনলোড স্পিড প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসা ফোরজি থেকে নেটওয়ার্ক ঘনঘন টুজিতে চলে যাওয়া আন্ডারগ্রাউন্ড বা বহুতল ভবনের টপ ফ্লোরে গেলে নেটওয়ার্ক না পাওয়া. এসব অভিযোগ বেশ পুরোনো। অনেক সময় দেখা যায় গ্রাহক ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনেছেন ঠিকই কিন্তু এসব ঝামেলা পোহানোর কারণে সেই ডেটা ভলিউম আর ব্যবহারই করা হয় না ।
অথচ গ্রামীণ ফোন কিছুদিন আগেই তাদের সাড়ে পনেরো হাজার টাওয়ারে এলটি সেবা চালু করেছে। বাংলা লিংকের প্রায় দশ হাজার টাওয়ারে এই সেবা চালু আছে অনেক আগে থেকেই. আরেক মোবাইল অপারেটর রবি তাদের এগারো হাজার বেজ স্টেশন বা টাওয়ারে ফোর পয়েন্ট ফাইভ জি বা এলটি অ্যাডভান্স চালু আছে বলে জানিয়েছে. যদিও রবি নেটওয়ার্ক কে বসানো ওক্লা সার্ভার গড়ে সাড়ে বারো এমবিপিএ করতে পারছে না. আন্তর্জাতিক মান থেকে এদেশের মোবাইল ইন্টারনেট স্পিড কতটা পিছিয়ে আছে তার একটা ছোট্ট প্রমান. গত জানুয়ারি মাসে আমাদের দেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গড় ডাউনলোড স্পিড ছিল দশ দশমিক পাঁচ সাত এমবিপিএস. আপলোড স্পিড সাত দশমিক এক নয় এমবিপিএস. অথচ উন্নত দেশগুলোতে এই গতিবেগ ছিল একশো থেকে একশো সত্তর এমবিপিএস এর ওপর. ফাইভ জি আসছে এই অজুহাত দেখিয়ে মোবাইল ফোন অপারেটররা দীর্ঘদিন ধরে তাদের থ্রিজি ও ফোরজি নেটওয়ার্ক উন্নয়নে কোন ধরনের বিনিয়োগ করেননি. টাওয়ার শেয়ারিং নিয়েও নানা সমস্যা আছে.
এছাড়া প্রয়োজনীয় স্প্রেকড্রাম না থাকার কারণে যে এলাকায় গ্রাহক বেশি সেই এলাকায় ইন্টারনেটের গতি ততই কম. যে এলাকায় যতটা বিটিএস প্রয়োজন ততটা নেই. ধরা যাক একটি অপারেটরের গ্রাহক সংখ্যা আট কোটি।
কিন্তু তাদের স্পেকট্রাম বরাদ্দ আছে মাত্র সাইত্রিশ মেগা হার্জস. যেখানে গ্রাহক হিসেবে তাদের থাকার কথা ছিল একশো মেগা হার্জস তরঙ্গ. অথচ মানসম্পন্ন সেবা না দিয়েও তারা মুনাফা অর্জন করছে.
করোনা কালে গত এক বছর কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই লাভের মুখ দেখেছে মোবাইল ফোন অপারেটররা. কিন্তু সেই লাভের একটা অংশ গ্রাহকদের ভালো ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার জন্য ব্যয় করেনি তাদের কেউই. অনেকেই বলেন বাংলাদেশের মোবাইল ইন্ডিয়ানের যে দাম উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক কম. কথাটা সত্য । আবার সেই কম দামটা থেকেও অপারেটররা প্রচুর লাভ করতে পারেন. কারণ আমাদের দেশে মোবাইল টাওয়ার প্রতি সক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যা অনেক, অনেক, অনেক বেশি. কিন্তু একই tower এ হাজার হাজার সক্রিয় গ্রাহক থাকলেও, তাদের মানসম্পন্ন সেবা দেওয়ার জন্য tower এর base band এর টেকনিক্যাল resource একেবারেই অপর্যাপ্ত. আমাদের দেশে প্রতিটি মোবাইল টাওয়ারের রিসোর্স হিসেবে সাধারণত পঁচাত্তর থেকে একশোটি ডাউনলোড ও আপলোড রিসোর্স থাকে. যেটা মোট গ্রাহকের চাহিদার তুলনায় অতি নগন্য.
এই resource সবার ভাগ করা হয় দুই বছরের ভিত্তিতে. এই কারণে speed টেস্টে internet এর যে গতিবেগ পাওয়া যায় বাস্তবে তার চার ভাগের এক ভাগও গ্রাহক পাননা. এ কারণে একই resource বেশি সংখ্যক ভোক্তার মধ্যে ভাগ হতেই থাকে. আর internet এর গতিবেগ কমতেই থাকে. এ কারণে Messenger বা WhatsApp এর কল ড্রপ কিংবা YouTube Facebook এর পেজ লোডিং নিয়মিত ঘটনা. মোবাইল অপারেটর গুলো পাল্টা দোষারোপ করে বিটিআরসিকে. ফোরজি প্রযুক্তিতে ব্যবহারের উপযোগী সাতশো আটশো নয়শো চোদ্দশো, আঠারোশো, একুশশো, ছাব্বিশশো এবং সাতাশশো ব্যান্ডের তরঙ্গগুলোকে বিটিআরসি সহজলভ্য করতে পারেনি. টেলিটক যেমন অল্প সংখ্যক গ্রাহক নিয়ে কিছু তরঙ্গ নষ্ট করছে তেমনি রেল বা সেনাবাহিনীর জন্য রিজার্ভে থাকা কিছু পরিমাণ তরঙ্গ অপচয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অপারেটরদের দাবি সব ধরনের রাজস্ব মিলিয়ে তাদের মোট আয়ের অর্ধেকেরও বেশি সরকারকে দিতে হয় । তাই উচ্চ মূল্যের ভালো নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইড করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের টেলি যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নতুন তরঙ্গগুলোর স্পেকট্রাম বরাদ্দের জন্য নিলাম আয়োজন করার ব্যাপারে যতটা আগ্রহী মোবাইল ইন্টারনেট সেবার ত্রুটিগুলো সারিয়ে ইন্টারনেটের সুফলভোগী কোটি কোটি মানুষের উপকার করার বেলায় ঠিক ততটাই যেন উদাসীন. হাজার হাজার ফিন্যান্সার তরুণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শহর এবং গ্রামাঞ্চলে. যারা ভালো ইন্টারনেট স্পিডের অভাবে বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন. অনলাইনে যেসব উদ্যোক্তারা ব্যবসা করেন যে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস করেন কিংবা যাদের হাই-রোজগার ইন্টারনেটের উপরেই নির্ভর করে. সেই মানুষগুলো পড়েছেন মহা বিপদে. অক্লার এই জরিপে বাংলাদেশের আট ধাপ উপরে থাকা দেশটার নাম উগান্ডা । যে দেশ কে নিয়ে আমরা সব সময় ট্রল করি তারাও আমাদের চেয়ে আট ধাপ এগিয়ে আছে মোবাইল ইন্টারনেটের জগতে।
জাম্বিয়া, তানজানিয়া, সোমালিয়ার, ঘানা, সুদান এবং জিম্বাবুয়ের মোবাইল ইন্টারনেট স্পিডও আমাদের চেয়ে অনেক বেশি.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন