মিস্টার শেফাডের ড্রইং ক্লাস নেবার কথা ছিল দুপুর তিনটায় । কিন্তু হঠাৎ তার বাসা থেকে জরুরি ফোন আসে তার মেয়ে এম বাসায় চিজ কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। তিনি দ্রুত স্কুল ত্যাগ করেন তার বাড়ি গিয়ে দেখেন ভয়ঙ্কর অবস্থা. ছোটলেন তিনি মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে.
এদিকে মিস্টার শেফার্ডের ড্রয়িং ক্লাস না নেওয়ার কারণে জাস্টিনদের স্কুল ছুটি হয় এক ঘন্টা আগে।বাসায় ফিরে সে তার মার কাছে আবদার করে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। জাস্টিনের বাবা সেদিন বাসায়। তাই তারা ঠিক করে সিনেমা দেখতে যাবে। প্রাইভেট কারে তারা বাসা থেকে বের হয় । কিন্তু সিনেমার টিকিট কাটতে গিয়ে তারা টিকিট পায় না।
ফলে জাস্টিন ও তার মা-বাবা ঠিক করে রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে। রেস্টুরেন্টে খাবার শেষে বাসায় ফেরার সময় হঠাৎ তাদের কারের টায়ার পামচার করে দেয়। জাস্টিনের বাবা জায়গা ঠিক করাতে। জাস্টিন এবং তার মা বাসায় ফেরে উবারে। বাসে ফিরতে না ফিরতেই কল আসে, জাস্টিনর বাবা টায়ার ঠিক করিয়ে ফেরার সময় অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন. তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে. জাস্টিন ও তার মা ছুটেন হাসপাতালের দিকে. এখানে থেমে একটি পেছনে ফিরি চলুন।
মিস্টার সেফার্ডের মেয়ে এম বাসায় চিজ কাটতে গিয়ে হাত কাটলো না। মিস্টার সেফার্ডের কাছে ফোনও আসলো না।তার ক্লাস ঠিক মতো চলল। ফলে জাস্টিনের স্কুল ছুটি হল যথা সময়।বাসায় ফিরে সে বাইরে যাওয়ার আবদারও করলো না। না থাকলেও সিনেমার টিকিট কাটার ঝামেলা না রইলো রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার বিষয় সবার বাসায় থাকার কারণে জাস্টিনের বাবার অ্যাক্সিডেন্টও হলো না সুতরাং দেখা যাচ্ছে সামান্য চিস কাটা থেকে জাস্টিনের বাবার অ্যাক্সিডেন্ট পর্যন্ত ঘটনার পরিবর্তন ঘটে গেল। শুধু তাই নয় জাস্টিনের বাবার কারণে যেসব মানুষ ব্যস্ত হলো তাদের প্রত্যেকের ঘটনা চক্রে একটা বিশৃঙ্খলা চলে আসলো। আবার যদি তারা সিনেমার টিকিট কাটতে পারতো তাহলে ঘটনা প্রবাহ হতো একদম অন্যরকম। একে বিজ্ঞানের ভাষায় সহজে ক্যাওয়াস থিওরি বা বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব বলে.
ওপরের ঘটনাগুলো কাল্পনিক. কিন্তু এ কথা একশো ভাগ সত্যি যে এই পৃথিবীর সব মানুষ একে অপরের কাজ দ্বারা কোন না কোন ভাবে প্রভাবিত । আর এখানেই আসে বিখ্যাত বাটারফ্লাই এফেক্টের কথা। বাটারফ্লা এফেক্টের কথা প্রথম উপস্থাপন করেন গণিত এবং আবহাওয়াবিদ এডওয়ার্ড লরেঞ্জ । আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সাইন্সের একশো ঊনচল্লিশ তম অধিবেশনে. তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন ব্রাজিলে যদি কোন একটি প্রজাপতি তার ডানা ঝাপটায় তবে সেই ডানা ঝাপটানোর সুবাদে টেক্সাসে টর্নেডো হতে পারে কিনা ? অনেকেই তার এই প্রশ্ন পাগলের প্রলাপ মনে করেছিল সে সময়। কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞান দেখে যেটা সম্ভব যেকোনো ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কাজ কোনো ঘটনার শেষ পরিণতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করতে পারে। আর এডওয়ার্ড লরেঞ্জ আসলে এটিই বোঝাতে চেয়ছেন তার বক্তব্যে. উনি গানিতিকভাবে দেখান যে বিশ্বের কোন তরঙ্গকে সামান্য পরিবর্তন করা হলে সেই পরিবর্তন বিশ্বের অন্য সকল তরঙ্গকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করে। সাধারণত অরৈখিক এবং অনিশ্চিত ঘটনা সমূহের বিজ্ঞানকেই বলা হয় বিশৃঙ্খলার বিজ্ঞান।
বিজ্ঞানের অন্য সব শাখা সাধারণত সরলরৈখিক গণিত নির্ভর এবং নির্দিষ্ট ফলাফল প্রাপ্তির ঘটনা নিয়েই কাজ করে। যেমন তড়িৎ বিজ্ঞান, মহাকর্ষক কিংবা রাসায়নিক বিক্রিয়া। কিন্তু বিশৃঙ্খলা তত্ত্বে সাধারণত ঘটনার একদম সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করা কখনই সম্ভব নয় । কিন্তু কিভাবে লরেঞ্জ পেলেন বাটারফ্লাই এফেক্টের আইডিয়া?
লরেঞ্জ ছিলেন আবহাওয়াবিদ. তিনি একদিন আবহাওয়ার পূর্বাভাস পুনরায় খতিয়ে দেখছিলেন, তখন দ্রুত কাজ করার জন্যে দশমিকের পরে ছয়টি সংখ্যা না নিয়ে তিনি তিনটি সংখ্যা নিয়ে হিসাবটির ফলাফল বের করেন। ফলাফল দেখে তিনি রীতিমতো অবাক হন. আগের হিসাব থেকে এই হিসাব সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু যে মান তিনি বাদ দিয়েছিলেন তা কিন্তু প্রায় শূন্যের কাছাকাছি । এমনকি আবহাওয়ার পূর্বাভাসের গ্রাফ দুটিতেও চলে আসে বিশাল পার্থক্য । তখন লোরেঞ্জ শুরু করলেন ঘাটাঘাটি। বিভিন্ন দশমিক সংখ্যা দিয়ে লরেঞ্জ হেরফের লক্ষ্য করছিলেন. প্রতিবার গ্রাফে বিশাল পার্থক্য. এত ক্ষুদ্র কিছু ডাটার জন্য আবহাওয়ার এই পুরোপুরি বিপরীত রূপ দেখে তিনি অবাক হন. তিনি পেশ করেন তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্র বাটারফ্লাই ইফেক্ট।
অর্থাৎ ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ের পরিবর্তনও বিশাল বিশৃঙ্খলা নিয়ে আসতে পারে । পরবর্তীতে ব্যাপক গবেষণা হয় butterfly fake নিয়ে। Batterfly effect এর সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ দেওয়া যায়. আর একটা গল্প বলে। উনিশশো ছয় সাল. ভেনা শহরে এক চিত্রশিল্পী ইহুদী কন্যার প্রেমে পড়েন তারই ছবি আঁকতে গিয়ে। ছেলেটি তার প্রিয় কুকুরটির মাধ্যমে মেয়েটির কাছে চিঠি পাঠাতো। ধর্ণাঢ্যমের পরিবার এই গরিব ছেলেটিকে মেনে নিতে রাজি হয়নি। একদিন তারা ছেলেটির কুকুরটিকে মেরে ফেলে। ছেলেটির জীবন বদলে যায় এই ঘটনায়। যোগ দেয় সেনাবাহিনীতে. উনিশশো-আঠারো সালে এক ব্রিটিশ সেনা তাকে পিটিয়ে জখম করে । শুধু তাই নয়, তাকে হত্যার আদেশও ছিল. কিন্তু ব্রিটিশ সেনা দয়া করে তাকে ছেড়ে দেয়. আর সেই ছেলে ছিল পরবর্তীকালের ভয়ঙ্কর শাসক এডলফ হিটলার.
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আনুমানিক তেষট্টি লাখ ইহুদী মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল তারই নির্দেশে। ধারণা করা হয় সেই ইহুদি মেয়ের পরিবারের কারণেই তার এত ঘৃণা ছিল ইহুদিদের প্রতি। আর কি হতো সেই ব্রিটিশ সেনা যদি সেদিন তাকে দয়া না করে হত্যাই করতো গোটা পৃথিবীর ইতিহাস বদলে যেত সেদিন । বাটারফ্লাই এফেক্টের আরো একটি গল্প বলি চলুক বারোশো-পঁচাত্তর সালের বেলজিয়াম জিয়ালি নামের এক রাজ্যের এক কৃষক তার পাশের রাজ্য থেকে একটি গরু চুরি করে। গরুটি তিনি বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যান । কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি, পাশের রাজ্যের একজন তাকে দেখে ফেলে গরু সহ । কৃষককে বলা হয় যদি সে গিয়ে গরুটি ফেরত দিয়ে আসে পাশের গ্রামে, তবে তাকে ক্ষমা করা হবে। কৃষকও ভালো মানুষের মতো গরুটি ফেরত দিতে যায় । কিন্তু সেই রাজ্যের রাজা তাকে আটক করে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে । এই ঘটনায় মারাত্মক ক্ষেপে যান জেলেরাজ্যের রাজা। মাত্র এক গরু চুরির জন্য কাউকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হবে? তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। এটাকে তিনি অপমান হিসেবে ধরে নেন এবং এই অপমানের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্যে পাশের রাজ্যের সাথে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেন । কে জানতো এই যুদ্ধের ফল এমন হবে, টানা তিন বছর ধরে চলে যুদ্ধ । শুধু যে তাদের মাঝে এই যুদ্ধ সীমাবদ্ধ থাকে তা কিন্তু নয় পুরো বেলজিয়ামে ছড়িয়ে যায় এই যুদ্ধ। ধ্বংস হতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম। প্রায় দুই লাখ মানুষ মারা যায় এই যুদ্ধে। বেলজিয়ামের ইতিহাসে এই যুদ্ধ দ্যাখা ভাসে বা ওয়ার অফ দ্য কাউ নামে পরিচিত । সামান্য গরু চুরির থেকে দুই লাখ মানুষের মৃত্য। কল্পনা করুন একবার, যদি সেই কৃষক সেদিন গরু চুরি না করতো তাহলে ইতিহাসই বদলে যেতে পারত। অবাক হলেও সত্যি যে butterfly effect দেখা গিয়েছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাতেও ।
উনিশশো বাষট্টি সালে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েই যেত। যদি না শেষ মুহূর্তে সঠিক বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ না করা হতো। সেদিন এক বিশেষ ভুল বোঝাবুঝির জন্য সোভিয়েত সাবমেরিন টপ টুডু লঞ্চ প্রায় করেই ফেলেছিলেন মার্কিন যুদ্ধ জাহাজের উদ্দেশ্যে। সোভিয়াত নিয়ম অনুসারে সাবমেরিন টর্পেটা লঞ্চের জন্যে ক্যাপ্টেন পলিটিকাল অফিসার এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড অফিসার এই তিন পদস্থ প্রত্যেক ব্যক্তির সম্মতির প্রয়োজন । কিন্তু বাকি দুজন সম্মতি দিলেও সেকেন্ড ইন কমান্ড অফিসার সম্মতি দেননি । তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই পারমাণবিক শক্তি সম্পন্ন দেশ ছিল । সে সময় এই দুই পরাশক্তি যুদ্ধে নেমে গেলে পারমানবিক বোমার ব্যবহার ছিল অনিবার্য । যার ফল হতো ভয়াবহ. এমনকি পৃথিবী থেকে মানুষের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারতো । এভাবেই খুব ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কাজ কোনো ঘটনার শেষ পরিণতিকে উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তন করতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে তাকালে আরো অজস্র উদাহরণ দেখা যায়। আপনার নিজের দিকে তাকালেও তা বুঝতে পারবেন খুব সহজে। ভুল বা সঠিক যেই সিদ্ধান্তই নিন না কেন, আপনার জীবন বদলাচ্ছে. প্রতিনিয়ত সেই বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব অনুসারে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন