এই তো কদিন আগেকার কথা. আমেরিকাকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে চীন. বিশ্বজুড়ে করোনার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকেই গত দুই বছরে চীনের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা. ঈর্ষণীয়. অন্যান্য দেশের জিডিপির প্রবৃত্তি যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে সেখানে চীনের জিডিপির গ্রোথ যেন আকাশে উড়ছে. কিন্তু এই উত্থানের পেছনে চীনের ব্যবসার পরিধি যতটা ভূমিকা রেখেছে প্রায় সমান ভূমিকা আছে সরকারের death trap diplomacy. গত দুই দশক ধরে শুধু অর্থনৈতিক পরশক্তিই নয় রাজনৈতিকভাবেও বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাষ্ট্র হওয়ার পথটা চীন যেভাবে কৌশলে তৈরি করে নিয়েছে সেটাকেই বলা হচ্ছে death trap diplomacy. আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারে চীনের স্বপ্নের প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এখন জলজ্যান্ত বাস্তব. আর সেই বি আর আই কে বাস্তবায়ন করতে গিয়েই চীন হেঁটেছে ঋণ দিয়ে বিভিন্ন দেশকে নিজেদের কব্জায় আনার পথে. সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হয়. সেটাই করছে চীন. যাদের কাছে টার্ম গুলো একটু খটমটে মনে হচ্ছে তাদের জন্য একদম সাধারণ একটা অজুহাত দিয়ে চীনের এই ঋণ ফাঁদের ব্যবসাটা খুঁজে পাওয়া । শ্রীলঙ্কার বন্দন নগরী সেখানে একটা গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা সরকার । কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত শ্রীলঙ্কার কাছে তখন বন্দর স্থাপনের মতো টাকা ছিল না. সেই দুঃসময়ে দেশটিকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে চীন. সে দেশের একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এই বন্দর নির্মাণের দায়িত্ব নেয়. চীনের এক্সিম ব্যাঙ্কের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে নির্মাণ করা হয় হাম্বানটোডা বন্দর । কিন্তু নির্মাণের অল্প কিছু দিনের মাথায় এক্সিম ব্যাংক সেই ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দেয় শ্রীলঙ্কাকে. কয়েক দফায় তারিখ বদলেও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার পর শ্রীলংকার সরকার বাধ্য হয় হাম্বানটোডা বন্দরটিকে চীনের একটি কোম্পানির কাছে নিরানব্বই বছরের জন্য লিজ দিতে।
সেই কোম্পানিটি রক্ষণাবেক্ষণের খরচটা রেখে বন্দর থেকে আয় হওয়া বাকি চীনের এক্সিম ব্যাঙ্কের কাছে জমা দেবে অর্থাৎ শ্রীলংকার বন্দরের মালিক এখন চীন। নিজেদের দেশের বন্দর শ্রীলংকাদের ব্যবহার করতে হবে টাকার বিনিময়ে. খেলাটা বুঝতে পারছেন? এরকম নমুনা আরো অজস্র দেখানো যাবে. চীনের দেওয়া ঋণে অর্ধাহিত উদ্যোগগুলো কিভাবে একটি দেশের গলার কাঁটা হয়ে উঠতে পারে. তার একটা বড় উদাহরণ হচ্ছে চীন ও তার প্রতিবেশী লাউসের মধ্যে রেলপথ নির্মাণের প্রকল্পটি। পার্বত্য এলাকা ভেদ করে যাওয়া এই রেলপথ এমনিতেই অনেক উঁচুতে স্থাপন করতে হয়েছে তাছাড়া ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ এবং টানেল তৈরিতেও খরচ হয়েছে বিস্তর। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পের বাজেট বেড়ে গিয়ে ঠেকেছে সেই আকাশে । লাউস নিম্ন মধ্য মায়ের দেশ এমন প্রকল্প তাদের জন্য আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু চীনের ব্যাংকাররা এই প্রকল্পে নাক গলানো মাত্রই সবকিছু যেন ভোজবাজির মতো বদলে গেলো। চীনের কয়েকটি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এবং রাষ্ট্রীয় ঋণদাতাদের একটি কনসর্টিয়াম এই প্রকল্পের সহায়তা দিলো ।
লাউস সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও নিজেদের আখের গুছিয়ে নেবার আশায় সাড়া দিলো ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে ।কিন্তু পাঁচশো নব্বই কোটি ডলারে বানানো এই রেল প্রোজেক্টের গ্লানি টা ঘাড়ের ওপরে কিভাবে চেপে বসবে সেটা সম্পর্কে লাউস সরকারের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না । সেই ঋণের বোঝা খাট থেকে নামানোর জন্য লাউস এখন তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত পটাশ খনির মূল্যবান ধাতু তুলে দিচ্ছে চীনের হাতে। কখনো বিনামূল্যে কখনো আবার স্বল্প দামে নিজেদের জ্বালানি গেটে কিছু অংশ লাউসের কাছ থেকে দখল করে নিয়েছে চীন. অথচ এই রেলওয়ে প্রকল্প করার উচ্চাবিলাস লাউসের ছিলোই না. মোটামুটি চীনের প্ররোচনায় তারা বাধ্য হয়েছে এই প্রজেক্ট হাতে নিতে. অথচ সেই রেললাইনের অধিকাংশেরই মালিক চীনা নিয়ন্ত্রিত রেলওয়ে গ্রুপ.
নাইজেরিয়াও পড়েছে ঋণের এই ঋণ ফাঁদের কবলে. এখানেও ঘাতকের নাম চীনের এক্সিম ব্যাংক. দু হাজার আঠারো সালে সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী চীনের চারশো মিলিয়ন ডলার ঋণ যদি সময়মতো শোধ করতে সমর্থ না হয় নাইজেরিয়া. তবে দেশটির সার্বভৌমত্ব ঝুঁকিতে পরবে. চীন বর্তমানে নাইজেরিয়ার বৃহত্তম বিদেশি বাণিজ্যিক অংশীদার এবং সবচেয়ে বেশি ঋণদাতা. ওয়েস্ট আফ্রিকার নেশনস ম্যানেজমেন্ট অফিসের তথ্য অনুযায়ী দিপাক্ষিক ও ঋণের আশি শতাংশই চীনের কাছ থেকে নিয়েছেন নাইজেরিয়া. আফ্রিকার সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনকারী দেশটিকে চীন এখন ঋণ দিয়েছে. রেলপথ নির্মাণ পাওয়ার প্লান্ট এবং বিমানবন্দর তৈরির জন্য. ইতিমধ্যেই প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ নাইজেরিয়াকে দিয়েছে চীন। সেগুলো শোধ করার তো নাম গন্ধই নেই উল্টো আরো নানা প্রজেক্টে এর চেয়েও বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে চীন। হাম্বানটোডার মতো কাছাকাছি ঘটনাও ঘটতে পারে কেনিয়াতেও । চীনের ঋণের ফাঁদে পড়েছে দেশটির সরকার। সময়মতো যদি চীনের ঋণ পরিশোধ করা না হয় তাহলে দেশটির প্রধান সমুদ্র বন্দর বাম্বাসা পোর্টের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি রয়েছে.
জি এখানেও খলনায়কের নাম চায়না এক্সিম ব্যাঙ্ক. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নব ভার্সন. চুক্তি অনুযায়ী পনেরো বছরের মধ্যে কিনিয়াকে সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করতে হবে. কিন্তু কেরিয়ার মতো অর্থনৈতিক দেশের জন্য পনেরো বছর কেন? পঞ্চাশ বছরেও এই বিশাল অঙ্কের ঋণ শোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়. তাহলে কি হবে বলুন তো? পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে মুম্বাসা বন্দরকেও একশো বছরের জন্য নিজেদের জিম্মায় নেবে চীনের কোন কোম্পানি । নিজেদের বন্দরকে নিয়ে একে ব্যবহার করতে হবে টাকা দিয়ে. মতো আর একটা চিত্রনাট্য লেখা হবে সেখানেও খুব শিগগিরই. নাইজেরিয়া বা কেনিয়ায় শুধু নয় প্রায় উনচল্লিশটি আফ্রিকান দেশে চীনের এমন সরব উপস্থিত রয়েছে এবং আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদারও কিন্তু চীন. চরম অর্থ সংকটে থাকা আফ্রিকান এই দেশগুলো চীনের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এবং ঋণ সহজেই স্বীকার করে নিয়েছে. যদিও এই ঋণের মাধ্যমে এই দেশগুলোর গলায় চীন নানা রকমের শিকল পরিয়ে দিয়েছে. জাম্বিয়ায় চীন তামার খনিতে বিনিয়োগ করেছে খনিগুলোতে চীন, লোকবল ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে. চিনা শ্রমিকরা জাম্বিয়ান শ্রমিকদের স্থান দখল করে নিয়েছে. যে কারণে জাম্বিয়ায় বেড়েছে বেকারত্ব । তা ছাড়া production cost কমানোর জন্য শ্রমিকদের ন্যূনতম মৌলিক অধিকারও রক্ষা করে না চিনা কোম্পানি গুলো. নিজেদের অ্যালুমিনিয়াম কারখানা গুলোকে সচল রাখতে চীন আফ্রিকার আরেক দেশ গিনি থেকে বক্সাইড সংগ্রহ করছে. বিশ্বের বক্সাইড রিজার্ভের একটা বড় অংশই রয়েছে গিনিতে। গিনির মোট জিডিপির দ্বিগুণ পরিমাণ ঋণ দেওয়ার আশ্বাসে বেশ কয়েকটি চিনা প্রতিষ্ঠান বক্সাইড রিজার্ভ গুলোতে খনন ও বক্সাইড উত্তোলনের অনুমোদন পেয়েছে । এদের বাইরেও চিনা ঋণে জর্জরিত হয়ে রয়েছে জীবুতি, মালদ্বীপ, মাদারগাস্কার, পাকিস্তান, দক্ষিন, আফ্রিকার মতো দেশগুলো । এ ছাড়াও মতি নিগ্রহ বা গ্রীসের মতো ইউরোপিয়ান দেশ যাদের অর্থনৈতিক তুলনামূলকভাবে শক্ত তারাও চীনা ঋণের এই জালে আটকে গেছে । আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে বিশ্ব ব্যাংক এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক কিংবা জাইকার মত প্রতিষ্ঠান গুলোতেও বিভিন্ন দেশকে ঋণ দেয়. নানা প্রকল্পের জন্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলো একে অন্যকে অর্থ সাহায্য করে থাকে. তাহলে চীনা ঋণ নিলে সমস্যা কোথায়? সমস্যাটা চীনের ইনটেনশানে।
চীন এসব দেশকে অর্থ ঋণ দিচ্ছে অন্য কায়দায়. এখানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে মঞ্জুরি বা ঋণের মাধ্যমে প্রকল্প অর্থায়ন করা হচ্ছে না. বরং চীন যে ঋণ দিচ্ছে তার প্রায় সবটাই আসছে রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের ঋণ হিসেবে. নথিপত্রে চিন থেকে নেওয়া এসব ঋণের কথা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয় না। কারণ চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর সাথে করা এসব চুক্তিতে অনেক সময় কেন্দ্রীয় সরকারের কোন প্রতিষ্ঠানের নাম থাকে না। ফলে এসব চুক্তি থেকে যায় সরকারের দলিলপত্রের বাইরে। তাছাড়া এতে গোপনীয়তা সংক্রান্ত যেসব ধারা থাকে তার ফলেও সরকার জানতে পারে না। ঋণ নেওয়ার সময় বন্ধ দরজার অভ্যাসে ঠিক কি সমঝোতা হয়েছিল । তাছাড়া চীন যেসব রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ঋণ দেয় তার বিপরীতে অনেক সময় অস্বাভাবিক রকমের জামানত দাবি করা হয় ইদানিং প্রায়ই চীনা ঋণগ্রহীতাকে প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করে পাওয়া নগদ অর্থ দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে । উদাহরণ হিসেবে লাউস, গিনি বা হাম্বানটোডার কথা বলা যায়. সম্প্রতি ভেনিজুয়েলার সাথে চীনের এমন একটি চুক্তি হয়েছে যাতে বলা হয় ঋণগ্রহীতা তেল বিক্রি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা পাবে তা সরাসরি চীন নিয়ন্ত্রিত একটি ব্যাংকের একাউন্টে জমা দিতে হবে. ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে চীনা ঋণদাতা সাথে সাথেই একাউন্টে থাকা সেই অর্থ তুলে নিতে পারবে অথচ বিশ্ব ব্যাংক এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক বা জায়গা কখনোই এমনটা করবে না। চীন মূলত দেশগুলোকে ঋণ দিচ্ছে তার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে.
বেল্ট অ্যান রোড বা এক অঞ্চল এক পথের নামের যে মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য চীন এতসব করছে. সেটা ঠিকঠাক ভাবে চাপিয়ে দেওয়া গেলে গোটা বিশ্বে চীনের দিকে মাথা তুলে তাকানোর মতো দেশ একটাও থাকবে না. এমনকি আমেরিকাও নয়. গোটা পৃথিবীর ষাট শতাংশ মানুষকে এই প্রকল্পের আওতায় আনার পরিকল্পনা আছে চীনের. এই জন্য নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে জর্জরিত করে তাদের ঘাড়ে চেপে বসছে দেশটি. বেল্ট অ্যান রোডের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপকে একই রোডে অন্তর্ভুক্ত করে গোটা অঞ্চলের একচ্ছত্র আধিপত্য নেবে চীন। দু হাজার ছয়শো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে সেজন্য। চীনা পণ্যের চাহিদা বা বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অর্থনৈতিক ভাবে প্রায় একশোটি দেশ পুরোপুরি চীনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে. চীনের সিদ্ধান্তের বাইরে তাঁরা যেতে পারবে না. এটাই চাইছে চীন. এই একনিষ্ঠ আনুগত্য. তাই ঋণের নামে বিলিয়ন মিলিয়ন ডলারও উড়াচ্চ্ছে. চীনের কাছে এটা ঋণ নয় বরং ইনভেস্টমেন্ট. এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশকে চীনের এই ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে? নাকি ইতিমধ্যেই এই death trap diplomacy তে ফেঁসে গেছি আমরা. এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে বাংলাদেশে চিনা বিনিয়োগের খানিকটা চিত্র তুলে ধরা যায়. দু হাজার দশ সালের কথা. পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ তখন সবে শুরু হতে যাচ্ছে. হুট করেই গোটা প্রোজেক্টের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনলো বিশ্ব ব্যাঙ্ক. সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দিলো তারা. সরে গেলো এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকও. বাংলাদেশ সরকার তখন অকূল পাহাড়ে পড়েছে. তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এলো চীন. তারা নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দিলো.
বাংলাদেশ সরকার যদিও তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়নি. তবে কারিগরি সহায়তা নেওয়া হয়েছে চীনের কাছ থেকে। চীনের টাকায় না হলেও চীনের সরাসরি সাহায্যেই নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতু. খেয়াল করলে দেখবেন মেট্রোরেল এবং রুপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সব বড় বড় প্রজেক্টেই কোনো না কোনো ভাবে চীন যুক্ত আছে. চীনের সাহায্যে এদেশে রাস্তা হচ্ছে, সেতু হচ্ছে, ফ্লাইওভার হচ্ছে, হচ্ছে বন্দর কিংবা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র. তাহলে কি হার্বার্ট বিজনেস ডিভিউতে বলা সেই চাইনিজ লোন ট্রাপের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশও. বাংলাদেশের পায়রা বন্দর নির্মাণের কাজে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছে চীন. দশ হাজার কোটি টাকা বাজেটে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ তৈরি হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে. সেটির কাজও করছে চীন. তাদের অর্থ সাহায্যও আছে সেখানে. পদ্মাসেতুতে রেল সংযোগের কাজ করছে চীনের প্রতিষ্ঠান. চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন সিআইসি. মজার ব্যাপার হচ্ছে এই প্রকল্পে একুশ হাজার ছত্রিশ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে চীনের এক্সিম ব্যাঙ্ক। হ্যাঁ সেই কুখ্যাত এক্সিট ব্যাঙ্ক যার কথা ভিডিওতে বেশ কয়েকবার শুনেছেন এছাড়াও পটুয়াখালির পায়রায় নির্মিত তেরোশো বিশ মেগা ওয়াট কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে চীন বিনিয়োগ করেছে ষোলো হাজার কোটি টাকারও বেশি. রাজধানী ঢাকার বিদ্যুতের আধুনিকায়নে বিনিয়োগ করেছে চীন. বিশেষত ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের আওতাধীন প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় বারো হাজার কোটি টাকা. এছাড়াও ঢাকা আশুরিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণে এগারো হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে চীন. প্রশ্নের জাগাটা স্বাভাবিক. শ্রীলঙ্কা, লাউস বা ক্যানিয়ার মতো পরিণতি কি আমাদেরও হবে. ভৌগোলিক ভাবে বাংলাদেশের অবস্থান চীনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
পায়রা বা চট্টগ্রাম বন্দরে যে কে বসতে পারলে বঙ্গোপসাগরে চীনের অবস্থান হবে সুসংহত. একই সাথে ভারত এবং আমেরিকাকে টেক্কা দেওয়া যাবে এই অঞ্চলে. এই সুযোগ কি চীন ছাড়তে চাইবে. গত কয়েক বছর ধরে ভারতীয় বলয় থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছে চীন. সেই চেষ্টার নমুনা দেখা গেছে পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ সাহায্য করার প্রস্তাবে কিংবা ছোট বড় নানা প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে. তাহলে কি ঘটবে সামনে? বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে একটি দেশের মোট জিডিপির চল্লিশ ভাগ বা তার বেশি যদি ঋণ হয় তাহলে সেই দেশ অর্থনৈতিক ভাবে বিপন্ন দশায় চলে যায়. বাংলাদেশের ঋণের পরিমান দেশের মোট জিডিপির চল্লিশ থেকে পনেরো শতাংশ. যার মধ্যে চীনের কাছ থেকে নেয়ার ঋণের পরিমান মোট ঋণের মাত্র ছয় পার্সেন্ট. বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত যেসব দেশ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণী তাদের মধ্যে বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের পরিমান আটত্রিশ শতাংশ, কৃষি উন্নয়ন ব্যাঙ্ক থেকে চব্বিশ দশমিক পাঁচ, জাইকা থেকে সতেরো, চীন থেকে ছয় দশমিক আট এক , রাশিয়া থেকে ছয় দশমিক এক আট এবং ভারত থেকে নিয়ে ঋণের শতকরা পরিমান এক দশমিক তিন শতাংশ. কাজেই বিপদ সীমা থেকে বেশ খানিকটা দূরেই আছি আমরা. এখনো পর্যন্ত. তাছাড়া বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে. কিস্তি পরিশোধে বাংলাদেশ কোনদিন ডিফল্ট হয় নি.
বাংলাদেশ সুপরিকল্পিত ও দক্ষতার সঙ্গে ঋণ ব্যবস্থাপনা করছে এখনো পর্যন্ত. তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে চীনের অর্থ সাহায্যে ধীরে ধীরে মেগা প্রোজেক্টগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীর ওপর থেকে নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারছে বাংলাদেশ. অন্যান্য দেশের জন্য চীনের ঋণ যেমন ফাঁস হয়ে দেখা দিচ্ছে বাংলাদেশের জন্য সেটাই অক্সিজেনের মতো কাজ করছে। অন্তত এখনো পর্যন্ত চিত্রটা এমনই বলা চলে। শেষ করতে চলেছি আজকের পর বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে আগামী দিনগুলোতে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য চীন যে খেলায় নেমেছে সেটাকে ডার্টি গেম বললে কিন্তু একদম ভুল হবে না । সেই কাদা এড়িয়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে চাইলে ।সার্বভৌমত্ব রাখতে চাইলে ঋণের পরিমান বাড়তে দেওয় যাবে না। ব্রিটেন বা আমেরিকা বিশ্বের বুকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিদ করেছিল অস্ত্র আর প্রযুক্তির জন্য। সেখানে চীন একটিও বুলেট খরচ না করে শুধুমাত্র টাকা আর বুদ্ধির জোরে গোটা বিশ্বকে কব্জা করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে । নব্য উপনিবেশিক এই আগ্রাসনের মোকাবিলা বুদ্ধি দিয়েই বাংলাদেশকে করতে হবে এবং সেটা করতে হবে চীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে সেই মিশনে বাংলাদেশ এখনো সঠিক রাস্তাতেই আছে তাতে কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন