পদ্মা সেতুর টোল নিয়ে এত কানাকানি হানাহানি কেন নেটিজেনদের মাঝে ? পদ্মা সেতু আদ্য কী বদলে দিতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ জীবন ?
সম্প্রতি বাংলাদেশের টক অফ দা টাউন পদ্মা সেতুর টোল. ট্রলের জোয়ারে ভাসছে টুল. কিন্তু কেন?
পদ্মা সেতুর টোলের প্রজ্ঞাপনে দেখানো হয় সর্বনিম্ন টোল একশো টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকারও বেশি. ঘোষিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয় মোটরবাইকের জন্য টোল গুনতে হবে একশো টাকা. যা আগে ফেলতে পারাপারের ক্ষেত্রে. ছিল সত্তর টাকা. প্রাইভেট কারের জন্য সাতশো পঞ্চাশ টাকা যা ফেরির ক্ষেত্রে ছিল পাঁচশো টাকা. আর মিনিবাসের ক্ষেত্রে চোদ্দোশো টাকা যা ফেরিতে ছিল নশো পঞ্চাশ টাকা. এভাবে সাধারণ বাস, মাইক্রো বাস, বড় বাস, ট্রাক ইত্যাদি যানবাহন ভেদে টোলের হার বেড়েছে ফেরির তুলনায় প্রায় দেড় গুন আর এই নিয়েই দুনিয়ার আলোচনা সমালোচনা । কেউ বলে ঠিকই আছে টুলের হার তো আর কেউ বলছে কি এটা মগের মূলক নাকি? পদ্মা সেতুর টোল জনসাধারণের স্বার্থের বাইরে চলে গেল কি? কিংবা পদ্মা সেতু থেকে প্রাপ্ত সেবার বিপরীতে নির্ধারিত টোল ঠিক কতটা যুক্তিসঙ্গত? নির্ধারিত টোল যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণে কতটা প্রভাব ফেলবে? বাংলাদেশ তো নিজস্ব অর্থায়নেই অর্থাৎ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পদ্মা সেতু প্রস্তুত করেছে. তাহলে জনগণের ওপর থেকেই তো আবার এত টোল ধার্য করা হচ্ছে কেন ? এমন নানাবিধ প্রশ্ন চারিদিকে প্রশ্ন ওঠাটাই কিন্তু স্বাভাবিক কারণ পদ্মা সেতুই বাংলাদেশের একমাত্র উন্নয়ন প্রকল্প যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। পদ্মা সেতুর বিস্তারিত নকশা প্রাক্কদল এ বলা হয়েছে প্রকল্পটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় চুয়াল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার বা বাংলাদেশের মোট আয়তনের ঊনত্রিশ শতাংশ অঞ্চলের তিন কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হবে. ফলে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে এই উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন আসবে? এটাই তো স্বাভাবিক. বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় নির্ধারিত পদ্মা সেতুর টোল কতটা যুক্তিসঙ্গত? আপনি হয়তো আপনার মতো করে একটা উপসংহারে পৌঁছবেন. হয়তো আপনি একটা একরৈখিক উত্তর দেবেন. যে নির্ধারিত টোল আপনার কাছে যুক্তিসঙ্গত অথবা না. পদ্মা সেতুর নির্ধারিত টোল আসলে কতটা যুক্তিসঙ্গত এবং কতটা জনগণের সাধ্যের মধ্যে সেটা বুঝতে হলে আমাদের কিছু প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন. এছাড়া যান চলাচল শুরুর পর এই রুটে অর্থনৈতিক সুশাসন নিশ্চিতে সরকার ব্যবসায়ী, বাস মালিক সমিতি, পরিবহন মালিক, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতির ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে তার উপরও নির্ভর করবে টোল নির্ধারণের দূরদর্শিতা। ব্রিজ টুল এই ব্যাপারটা আসলেই কি ?
কোনো একটি সেতু নির্মাণের বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার এবং নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির সাথে ঋণ পরিশোধ রক্ষণাবেক্ষণ খরচ নির্বাহের লক্ষ্যে সরকার যখন প্রদত্ত সেবার বিনিময়ে একটা নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ যানবাহনের উপর ধার্য করে. তাকে বলা হয় ব্রিজ টোল. টোল সংগ্রহের ইতিহাস কিন্তু অনেকপুরোনো। তবে বর্তমানের সাথে টুল সংগ্রহ প্রক্রিয়ার তেমন কোন পার্থক্য নেই বললেই চলে. পৃথিবীর প্রথম টুল ধার্য করা হয় বারোশো নয় সালে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া ওল্ড লন্ডন ব্রিজের উপর যা ঐতিহাসিক টেমস নদীর উপর নির্মিত হয়েছিল. পদ্মাসেতুর টোল সংগ্রহ ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণের কাজেও দুইটি কর্পোরেশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়. একটি হলো কোরিয়ার এক্সপ্রেস কর্পোরেশন কেইসি আর একটি হলো চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এমবিএসসি. এখন দেখা যাক টোল নির্ধারণের ক্ষেত্রে কি কি মানদণ্ডটাও বিবেচনা করা হয়.
প্রথমত ফেরতের হার বা রেট অফ রিটার্ন। একটি মেগা প্রজেক্টে বা বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলে ওই প্রকল্পের প্রাক সম্ভাব্যতা এবং সম্ভাব্যতা অধ্যায়ন করতে হয়. তার ওপর ভিত্তি করে একটি অর্থনৈতিক সমীক্ষা তৈরি করতে হয়. অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা হয় রাষ্ট্র নির্দিষ্ট প্রকল্পের পেছনে যে টাকা খরচ করবে তার বিপরীতে ওই নির্দিষ্ট প্রকল্প থেকে জনগণ কি পরিমান সুবিধা পেতে পারে? একটি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত তখনই সঠিক হবে যখন ফেরতের হার কমপক্ষে বারো শতাংশ হবে । অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী পদ্মা সেতুর ফেরতের হার উনিশ শতাংশ অর্থাৎ একজন নাগরিকের পদ্মাসেতুর জন্য একশো টাকা খরচ করলে সে তার বিনিময়ে একশো উনিশ টাকা সুবিধা ফেরত পাবে । দ্বিতীয়ত হচ্ছে শ্রম ঘন্টা
একটি মৌলিক প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। এই মানব সভ্যতার প্রতিটি সৃষ্টি বা উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্দেশ্য কি? সহজ কথায় আমাদের জনজীবনের দক্ষতা বৃদ্ধি করা. আমরা কত সময় ব্যয় করে কত বেশি পরিমাণ কাজ করতে পারি দক্ষতা তারই একটি সূচক. পদ্মা সেতুর সকল সুফলকে যদি এক অর্থে ব্যাখ্যা করতে চাই তাহলে বলতে হবে পদ্মা সেতু আমাদের জীবনে দক্ষতা বৃদ্ধি করবে । পদ্মা সেতু না থাকাকালীন একজন ব্যক্তির ঢাকা থেকে খুলনা যেতে হয়তো সাত থেকে দশ ঘন্টা পর্যন্ত সময় দরকার হতো । কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হলে হইতো চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই চলে যেতে পারবে. এই যে বেঁচে যাওয়া সময়কে কাজে লাগিয়ে একজনের পক্ষে আরো শ্রম উৎপাদন করা সম্ভব. যার মাধ্যমে হয়তো তার আয় হবে অনেক বেশি. পদ্মা সেতু থেকে সেবা গ্রহণের ফলে আমাদের কি পরিমান শ্রমঘণটা বেঁচে যাবে সেটাও টোল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে কাজ করে।
তৃতীয়ত প্রাথমিকভাবে দৈনিক যানবাহন চলাচলের সংখ্যা বা ইনিশিয়াল ডেইলি ট্রাফিক এবং যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি ট্রাফিক গ্রোথ। বর্তমানে মাওয়া জাজিরা ফেরিঘাট দিয়ে প্রতিবছর প্রায় দশ লক্ষ যানবাহন এবং দুই কোটি দশ লক্ষ মানুষ চলাচল করে । যেখানে দৈনিক যাত্রী চলাচল করে প্রায় আটান্ন হাজার । জাইকার মতে সেতু চালু হবার পর দশ বছরের যানবাহন চলাচল পূর্বাভাস বা ট্রাফিক ডিমান্ড ফোর ক্যাস্ট বিবেচনা করে বলা হয় পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন যানবাহন চলাচল করবে একচল্লিশ হাজার পাঁচশো পঞ্চাশটি. অর্থাৎ পদ্মা সেতু শুরু হলে বর্তমানের তুলনায় নয় গুণ বেশি যান চলাচল করবে এই রুটে. তারমানে একটি গাড়ি সর্বোচ্চ আগের চেয়ে আট বার বেশি চলাচল করতে পারবে. তার মানে টোলের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে সে প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশন করতে পারবে.
চতুর্থত ঋণের পরিমান. সুদের হার ঋণ পরিশোধের ব্যাপ্তি. বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সাথে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী সেতু বিভাগকে ত্রিশ হাজার একশো তিরানব্বই দশমিক উনচল্লিশ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার. যা এক শতাংশ সুদ হারে পঁয়ত্রিশ বছরের মধ্যে পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ. এই লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রেখেই সেতু কর্তৃপক্ষ টোল নির্ধারণ করেছে. এবার আসা যাক পদ্মা সেতুর টোল নির্ধারণের সীমাবদ্ধতা নিয়ে । নির্ধারিত টোল বর্তমানে চলমান মুদ্রাস্ফীতি এবং জনগণের ক্রয় ক্ষমতার সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক. যেহেতু দিন শেষে এটা ব্যবহার করবে জনগণ. তাই তাদের এই মূল্যে সেবা গ্রহণের অভিপ্রায় বা উইলিং ইনস্টিটিউটিক সার্ভিস কতটা নিরীক্ষণের বিষয়ে গবেষণার দরকার ছিল বলে অনেকেই মনে করেন. একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রথমেই পূর্ণদমে হয় না. একটা প্রকল্প মিনিমাম লেভেলে উৎপাদনশীল হতেও কিছুটা সময় নেয়।
অর্থাৎ একটি প্রকল্প থেকে ব্যয়ের চেয়ে বেশি সুবিধা একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আসতে থাকে. এই ব্যয় সুবিধা, অনুপাত সমান বা বেশি হওয়ার আগ পর্যন্ত জনগণের জন্য অতিরিক্ত চাপ যে পড়বে এটা কিন্তু বলাই যায়. এটা ঠিক পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের পণ্য ঢাকায় খুব সহজে চলে আসবে এবং ঠিক তেমনি পচনশীল পণ্য পরিবহনের ঝুঁকিও কমবে. কিন্তু এর ফলে আরেকটা সমস্যার সৃষ্টি হবে. সমস্যাটি হল দক্ষিণাঞ্চলের সমজাতীয় পণ্য যখন অন্য জেলা থেকেও আসবে তখন দুই অঞ্চলের পণ্যের দামের তারতম্য দেখা দেবে. এই দামের তারতম্য সরকার কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেটা কিন্তু একটা দেখার বিষয়.
ঢাকা থেকে সড়ক পথে খুলনার দূরত্ব প্রায় দুশো পঞ্চান্ন কিলোমিটার. কিন্তু পদ্মাসেতু দিয়ে যাতায়াত করলে দূরত্ব কমে দাঁড়াবে একশো নব্বই কিলোমিটার । পঁয়ষট্টি কিলোমিটার পথ কমে আসবে. এতে জ্বালানি খরচ কমবে. সাধারণত বেশিরভাগ বাস চলে ডিজেলে. এক লিটার ডিজেলের দাম পঁচাশি টাকা। পঁয়ষট্টি কিলোমিটার পথ কমে যাওয়ায় ঢাকা খুলনা বাসে জ্বালানি খরচ কমবে প্রায় এক হাজার সাতশো পঁচাশি টাকা. ট্রাকে জ্বালানির খরচ কমবে এক হাজার একশো সত্তর টাকা. ট্রলারে দু হাজার সাতশো তেষট্টি টাকা. মাইক্রো বাসও ব্যক্তিগত গাড়িতে পাঁচশো ঊনআশি টাকা এবং মোটরসাইকেলের জ্বালানির খরচ কমবে একশো চৌত্রিশ টাকা। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা যশোরের দূরত্ব বর্তমানে দুশো বারো কিলোমিটার থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার কমে যাবে। এতে বাসে জ্বালানি বাঁচবে প্রায় সতেরো লিটার। অর্থাৎ টোল খরচ বাড়লেও যানবাহনগুলোর জ্বালানি খরচ কমে যাচ্ছে। সেকথা বিবেচনায় রেখে কতটা ভারসাম্যপূর্ণ ভাড়া নির্ধারণ হয় সেটাও কিন্তু দেখার বিষয় । ভারসাম্যপূর্ণ ভাড়া যদি নির্ধারিত না হয় তাহলে জনগণকে দুর্ভোগে পড়তে হবে. মানুষের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় তখন যখন সে তার স্বপ্নের বাস্তবায়নকে একটু একটু করে দেখতে পাই. আমরা এমনই সময় পার করছি. স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তবতার দাঁড় প্রান্তে. পদ্মা সেতুর ব্যবহারে আমরা কতটুকু স্বচ্ছতা এবং অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি. তাই বলে দেবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু থেকে আমরা কতটুকু উপকৃত হব?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন