জীবনে এ প্লাস পাওয়াই কি সব? এবার এসএসসি পরীক্ষায় যারা এ প্লাস পাননি তাদের জীবন কি শেষ হয়ে গেলো?
পরীক্ষাহীন একটা শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবুন তো ? এখন পাশের বাড়ির বন্ধু SSC তে golden A plus পেয়েছে বলে খোটা শুনতে হয়(গোল্ডেন a+ বলে কিছু নেই) । অপেক্ষাকৃত কম গ্রেড পাওয়া ছাত্রটিকে. কিন্তু একটা সময় এমন কোন ব্যাপারই ছিল না. আসলে তখন কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাই ছিল না. ভারতীয় উপমহাদেশের কথাই ধরা যাক না কেন এই অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল অনেকটা গুরু বা শিক্ষক নির্ভর. প্রাথমিক অবস্থায় শিক্ষা ছিল মূলত পেশার সাথে সম্পর্কিত. কিন্তু আধুনিক সময়ে এসে শিক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন. শিক্ষার গতি, প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়. আর আজকের আলোচনা শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যায়নের গুরুত্ব নিয়ে. বিশেষ করে আমরা বোঝার চেষ্টা করবো বাংলাদেশের ভ্যালুয়েশন সিস্টেম কতটা কার্যকর.
আমাদের দেশের ক্ষেত্রে evaluation এর কথা মাথায় আসলেই পরীক্ষার ফলাফলের কথা চলে আসে. অথচ মূল্যায়ন এবং পরীক্ষার মধ্যে আছে বেশ কিছু পার্থক্য. মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একটা সংকীর্ণ অর্থে পরীক্ষাকে ব্যবহার করা হয়. অন্যদিকে শিখন ফল ভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীরা ঠিক কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে তা নির্ধারণের প্রক্রিয়াই হচ্ছে মূল্যায়ন. আভিধানিক অর্থে শিক্ষাগত মূল্যায়ণ হলো শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর অতীত আচরণের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে সম্পাদিত আচরণের সাপেক্ষে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মূল্য আরোপ করা. অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে মূল্যায়ণ কেবলমাত্র একটি পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করেন না. মূল্যায়ন আরো বিস্তৃত একটা ধারণা. ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে পরীক্ষা একটা ধারণা হিসেবে প্রাচীন চীনের প্রথম উদ্ভাবিত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাজ্য পরিচালনার জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে লোক নির্বাচন করা। পৈতৃক সূত্রে বা জন্ম সূত্রে কেউ যেন আর বিবেচিত হতে না পারে। ব্রিটিশদের হাত ধরে সেই পরীক্ষাই এখন হয়ে উঠেছে শিক্ষায় মূল্যায়নের গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থায় বিভিন্ন স্তরে নানা ধরনের পরীক্ষা হয়. এর মধ্যে কয়েকটি পাবলিক পরীক্ষাও আছে. সেগুলোর ফলাফল একাডেমিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই. সামাজিকভাবেও খুব তাৎপর্যপূর্ণ. বাবা মা এমনকি শিক্ষকেরাও তাকিয়ে থাকেন দিন শেষে ওই পরীক্ষার ফলাফলের উপর. এখন প্রশ্ন হচ্ছে পরীক্ষা মূল্যায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলেও আসলেই কি কোন একটি পরীক্ষার ফলাফল সঠিকভাবে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক শিক্ষা জীবনকে মূল্যায়ন করতে পারে? শিক্ষার্থী হিসেবে আপনি সারা বছর ধরে যা শিখলেন শিক্ষক হিসেবে যা শেখালেন, পরিবার হিসেবে আপনার সন্তানের সুশিক্ষার জন্য শারীরিক, মানসিক, আর্থিক যে ত্যাগ, দিনের পর দিন আপনি করলেন. এক্সামিনেশন নামক মাত্র একটি মানদণ্ডে তাকে মূল্যায়িত হতে পারে?
দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশের ক্ষেত্রে জিপিএ ফাইভ হয়ে গেছে শিক্ষার আল্টিমেট উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য ।আরো নির্দিষ্ট করে বললে জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তের সংখ্যা কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নতির সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়. শিক্ষাক্ষেত্রে এটি কি কোনো বার্তা বহন করে?
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি দিনে দিনে আরো সমৃদ্ধ হচ্ছে?
ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যে প্রাথমিক পর্যায়েও পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছিলো. ছোট শিশুদেরকে মুখোমুখি করা হয়েছিল জিপিএ ফাইভ নামের এক মানদণ্ডে। অথচ আধুনিক বিশ্বের শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রসর অনেক বেশি শিশুদের জন্য কোন পরীক্ষাই নেই। উন্নত বিশ্বে আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্টের অংশ হিসেবে ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্টকে ব্যবহার করা হয়. কোন মার্কিং নেই, নেই কোন রাঙ্কিং. হাই স্কুলের ছাত্রদের জন্য. বছর শেষে একটি পরীক্ষা ছাড়া বেশিরভাগ উন্নত দেশে. কোন বাধ্যতামূলক পরীক্ষা নেই. সম্প্রতি শিক্ষা ক্ষেত্রে আর এক অগ্রগণ্য দেশ সিঙ্গাপুরেও প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরীক্ষা মুক্ত করা হয়েছে. দু হাজার উনিশ সাল থেকে প্রাথমিক স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য মার্কিং ও গ্রেডিং এর বদলে আলোচনা, হোমওয়ার্ক ও কুইজ নিয়ে আসা হয়েছে. অর্থাৎ এই দুই বছর শিক্ষার্থীরা কোনরকম পরীক্ষার চাপ ছাড়াই হাসি আনন্দে শিক্ষা লাভ করতে পারবে । সামগ্রিকভাবেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অন্যান্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষাকে অপেক্ষাকৃত কম প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করা হয়েছে.
আবার ফিরে আসা যাক শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল্যায়ন ব্যবস্থার দিকে. বাংলাদেশের মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়ে বরাবরই বিতর্ক রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিতর্কের মাত্রা কেবলই বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিতর্ক আরো তীব্রতর হয়েছে গত তিন দশকে। বিশেষ করে বহু নির্বাচনী প্রশ্ন এবং সৃজনশীল প্রশ্ন প্রবর্তনের পর. এই দেশে সৃজনশীল প্রশ্ন প্রবর্তন করা হয়েছে কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই. অনেক শিক্ষকই যা ঠিক মতো এখনো বুঝেই উঠতে পারেননি. যার ফলে মূল্যায়ন ব্যবস্থায় নেমেছে একটা গুণগত ধস.
আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেঞ্জামিন ব্লুম উনিশশো ছাপান্ন সালে শিখন উদ্দেশ্যকে জ্ঞানমূলক ক্ষেত্র, বিশ্বাস বা অনুভূতিমূলক ক্ষেত্র এবং মনোপ্রেসিজ ক্ষেত্রে ভাগ করেন. জ্ঞানমূলক দক্ষতা মূলত শিক্ষার্থীর জ্ঞান সম্পর্কিত যাবতীয় দক্ষতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত । যেগুলো লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ণ করা যায়। শিখন কার্যক্রম শিক্ষার্থীর নিজের বিশ্বাস ও অনুভূতিতে কি ধরনের পরিবর্তন আনছে তা বিশ্বাস এবং অনুভূতি দক্ষতার প্রধান বিবেচ্চ্য বিষয় এবং কিছুটা লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পরিমাপ করা গেলেও মূলত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মূল্যায়ন সবচেয়ে কার্যকর. এর অভাব বাংলাদেশ হারে হারে বুঝতে পারছে.
কোন কিছু শেখার পর হাতে কলমে সেটি করতে পারা মনোঃপেশীজ দক্ষতার অন্তর্ভুক্ত. আমাদের দেশের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বিশ্বাস অনুভূতি মূলক দক্ষতা, মনোপেশী যে দক্ষতা ভিত্তিক মূল্যায়ন এমন একটা গুরুত্ব কোনদিনই পাইনি. যদিও আচরণের কাঙ্খিত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই দুটি দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ. আমরা কেবল জ্ঞানমূলক দক্ষতা ভিত্তিক মূল্যায়নের ভিত্তিতেই একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করছি. ব্লু মস টেক্সেনমি অনুযায়ী জ্ঞানমূলক দক্ষতার ছয়টি ধাপ হচ্ছে স্মরণ, উপলদ্ধি, প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ এবং মূল্যায়ন.
আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকেরা ব্লুমস জ্ঞানমূলক ক্ষেত্রের বারোটা বাজিয়ে ছয় স্তরের শিখন ফলককে চার স্তরে নামেয়ে এনেছেন ।
প্রথম তিন ভাগ ঠিক রেখে শেষের তিন ধাপকে একসঙ্গে উচ্চতর দক্ষতা হিসেবে বিবেচনা করেছেন । ব্লুমস সাহেব যদি জানতেন তার কগনেটিক ডোমেনের এমন বারোটা বাজিয়ে দেবে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা তাহলে হয়তো তিনি এই তত্ত্ব দিতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতেন ।
সৃজনশীলতার যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছিল সেটা ঠিক এই কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ. তবে আশার কথা হচ্ছে একটু দেরিতে হলেও দু হাজার পঁচিশ সাল থেকে নতুন এক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ. একেবারে রূপান্তর ঘটাতে হবে. এই পরিবর্তন আসছে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, পাঠ্যক্রম ও বিষয়ভিত্তিক বিভাগ সবখানে এই পরিবর্তন আসবে. মূল্যায়নের ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে এবার. নতুন শিক্ষাক্রমে এখনকার সিস্টেমে আর এসএসসি ওএইচএসসি পরীক্ষা হবে না শুধু দশম শ্রেণীর পাঠ্য সূচী অনুসারে এসএসসি পরীক্ষা হবে । একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে বোর্ডের অধীনে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে দুইটি পরীক্ষার ফলাফল সমন্বয় করে চূড়ান্তভাবে এইচএসসি ফলাফল ঘোষণা করা হবে.
সবচেয়ে বড় কথা. শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণী পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাসে পড়বে. তাদের শেখার দশটি ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে. তবে প্রাক প্রাথমিকে কোন বই থাকবে না. তারা শ্রেণীকক্ষে সরাসরি শিক্ষকের কাছ থেকে শিখবে. একাদশ শ্রেণীতে গিয়ে মানবিক বিজ্ঞান ও বাণিজ্য এই তিন ভাগে ভাগ হবে.
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রাক প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির চেয়ে এই সময় ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে । তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত প্রচলিত কোনো পরীক্ষা হবে না । আগামী বছর প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণীতে এই পদ্ধতি চালু হবে. দুহাজার চব্বিশ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণী, দুহাজার পঁচিশ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণী, দুহাজার ছাব্বিশ সালে একাদশ এবং দুহাজার সাতাশ সালে দ্বাদশ শ্রেণীতে নতুন এই পদ্ধতি চালু হবে. আসতে থেকে হলেও এটা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশাল পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা যায়.
এই পুরো প্রক্রিয়াকে শিক্ষা গবেষকরা দেখছেন আমূল পরিবর্তন হিসেবে. তারা বলছেন উন্নত বিশ্ব সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সব সময়ই পরিবর্তন আনছে. তারা যেটা অনেক আগে করেছে সেটা আমরা এখন করতে যাচ্ছি. কিন্তু মাথা চুলকানোর মতো বিষয় হলো এই পরিবর্তনের সুফল পেতে হলে যা করতে হবে তা কতটা সঠিকভাবে করা হবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় কিন্তু রয়েই গেল. যেহেতু প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে. তাই শিক্ষকদের এক্ষেত্রে হতে হবে অনেক বেশি যোগ্য এবং স্বাধীন. তবে তাদের যা বেতন কাঠামো তাতে ওই পর্যায়ের যোগ্য শিক্ষক পর্যাপ্ত পাওয়া যাবে কিনা সেই আশঙ্কাও কিন্তু থেকে যাচ্ছে. কারণ যোগ্য শিক্ষক ছাড়া এই পর্যায়ের মূল্যায়ন সম্ভব না। যেহেতু একজন শিক্ষককে আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি ক্লাসে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ণ করতে হবে. তাই শিক্ষকদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং এর সুব্যবস্থা করাটা কিন্তু বাধ্যতামূলক. এই নিবিড় পদ্ধতির জন্য শিক্ষকের সংখ্যা এবং যোগ্যতা দুটোই বাড়াতে হবে.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন