. স্পেস স্টেশন ! মহাশূন্যের ওপরে অদ্ভুত এক দুনিয়া পত্র পত্রিকা বা টেলিভিশনের খবরে এই বস্তুর খবর শুনে বা পড়ে থাকলেও মহাকাশ স্টেশন সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই. তবে একটা আলাপ হয়তো ইদানিং অনেকের কানেই এসেছে. ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সঙ্গে স্পেস স্টেশনের বাকি অংশীদার দেশগুলোর বিশেষ করে আমেরিকার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে.
রাশিয়া ইতিমধ্যেই এই স্পেস স্টেশন প্রকল্প থেকে সরে গিয়ে নিজেদের আলাদা স্পেস স্টেশন বানানোর কথা ভাবছে. কাজেই শঙ্কায় পড়েছে বর্তমান স্পেস স্টেশনের ভবিষ্যৎ. পৃথিবীর বাইরের মানুষের নির্মিত সবচেয়ে বড় স্থাপনাটির ভাগ্যে. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ অনুসন্ধান, গবেষণা বা অন্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে মহাকাশে space craft বা মহাকাশযান পাঠায়. সেগুলো নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করে আবার ফিরে আসে পৃথিবীর মাটিতে. স্পেস স্টেশন হচ্ছে পৃথিবী থেকে দুশো পঞ্চাশ মাইল উপরে অবস্থিত বিশাল আকারে মহাকাশযান. এটি প্রতিদিন প্রায় ষোলোবার পৃথিবীর চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে চলেছে. এই স্টেশনের মূল উদ্দেশ্য হলো মহাকাশ বিষয়ক গবেষণাকে আরো বেশি ত্বরান্বিত করা. ভবিষ্যতে মহাকাশে মানুষের অভিযান, মাইক্রো গ্রাভিটি, মহাকাশে জীবের টিকে থাকা ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করা হয় এখানে. আর এই মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন বা সংক্ষেপে. আইএসএস।
বিশ্বের ষোলটি দেশের বাঘা বাঘা পাঁচটি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা যৌথভাবে এই সমন্বিত প্রকল্পটি তৈরি করে. এই পাঁচটি সংস্থা হচ্ছে রাশিয়ার রুশ মহাকাশ সংস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসা, জাপানের মহাকাশ অনুসন্ধান সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা এবং কানাডার কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি. দু হাজার সাল থেকে বিভিন্ন দেশের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা আইএসএস এ কাজ করছেন. এদের অধিকাংশই মার্কিন এবং রুশ বিজ্ঞানী. বিগত দশ বছর ধরে রাশিয়ার স্পেস ক্যাপসুল এই স্টেশনে বিজ্ঞানীদের এবং রসদ আনা নেওয়ার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে. এছাড়া মহাকাশে আইএসএসের অবস্থান এবং দিক নির্দেশনা ঠিক রাখতে রাশিয়ার উপর নির্ভর করেন নাসা. এটা থেকে প্রমাণিত হয় যে পৃথিবীতে অন্যকে থোড়াই care করলেও অন্তত মহাকাশে পরশক্তি গুলো বিশেষ করে রাশিয় ও আমেরিকা একে অন্যের উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। মহাকাশ থেকে এবার মর্তে ফিরে আসি চব্বিশ ফেব্রুয়ারী দু হাজার বাইশ ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে ভোরবেলা রুশবাহিনী ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করে. ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর মিত্র দেশগুলো. পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার ওপর আরোপিত সাম্প্রতিক অবরোধ নিষেধাজ্ঞা তুলে না নিলে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন প্রকল্পে অংশ নেওয়া দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধের ঘোষণা দেয় রাশিয়া. এখন রাশিয়া যদি তাদের নভোচারীদের ফিরিয়ে নিয়ে এসে নিজেদের স্পেস ক্র্যাপ সৈয়সকে অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখে. তাদের হয়তো বা তেমন কোনো ক্ষতি নেই. কিন্তু এর ফলে নিঃসন্দেহে অন্যান্য দেশের নভোচারীদের জীবন ও গবেষণায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে. Iss প্রকল্পের সঙ্গে রাশিয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করার তারিখ খুব শিগগিরই ঘোষণার কথা জানিয়েছে রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থার প্রধান দিবেন্দ্র রুবি সিং. এছাড়া রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতা ছাড়া মহাকাশ স্টেশনটি পৃথিবীতে আছড়ে পড়তে পারে বলেও সতর্ক করেন তিনি. রাশিয়া যদি সহযোগিতা বন্ধ করে দেয় তাহলে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের ভবিষ্যৎ কি এটা নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন.
একটা সময় ছিল যখন মহাকাশ স্টেশনের কথা সাইন্স ফিকশনের গল্পে ঠাঁই পেত কিন্তু সেটি বাস্তবে পরিণত হয় বিংশ শতকের একেবারে শেষ ভাগে এসে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের আলোচনা করতে গেলে যেই মানুষটার নাম সবার আগে উঠে আসে তিনি হলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুনাল রিগান। উনিশশো চুরাশি সালের পঁচিশ জানুয়ারি তিনি নাসাকে বিভিন্ন দেশের সহযোগিতায় এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দশ বছরের মধ্যে একটি স্পেস স্টেশন নির্মাণ করার নির্দেশ দেন. উনিশশো ছিয়াশি সালে আমেরিকার স্পেস শার্টাল চ্যালেঞ্জের দুর্ঘটনায় সাত নভোচারীর মৃত্যু হয়. এই দুর্ঘটনার প্রায় সতেরো বছর পর আবারো নাসার সেই স্পেস সার্টেল প্রোগ্রামেরই মহাকাশযান কলম্বিয়ায় বিধ্বস্ত হয় দু-হাজার-তিন সালে. এই মহাকাশযানে থাকা সাতজন ক্রু মেম্বারই মৃত্যুবরণ করেন. এরপরই নাসা শুরু করে ঘটনার তদন্ত. দুই বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় স্পেস সার্টেল পাঠানো আর তখন থেকে এখন পর্যন্ত আইএসএসের রসদ ও ক্রু পাঠানোর একমাত্র মাধ্যম রাশিয়ার সৈউস। দুহাজার সাল পর্যন্ত আইএসএস নভোচারীদের বসবাসের উপযোগী ছিল না । দুহাজার সাল পর্যন্ত জীবনধারণের নানা সুযোগ সুবিধা যুক্ত করে একে নবচারীদের বাসযোগ্য করা হয়েছে। দু হাজার সালের নভেম্বরের পর থেকে মহাকাশচারীরা নিয়মিতভাবে এখানে বসবাস করছেন। এই স্টেশনে সার্বক্ষণিকভাবে ছয় থেকে সাতজন নভোচারী অবস্থান করেন, তাদেরকে এখানে রাখার প্রধান উদ্দেশ্য হলো এমন সব গবেষণা করা যেগুলো শুধুমাত্র মহাশূন্যে বসেই করা সম্ভব।
এই স্টেশনে কর্মরত প্রত্যেক মহাকাশচারি অবস্থানের সময়সীমা থাকে কমপক্ষে ছয় মাস কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে কাউকে প্রায় বছর খানেকও এখানে থাকতে হয়।
রুশ মহাকাশ সংস্থা এর চিফ এক ট্যুইট বার্তায় লেখেন যেহেতু আমেরিকা আমাদের স্পেস ইন্ডাস্ট্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তাই তাদের উচিত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যাওয়ার জন্য ট্রাম্প পোলিং ব্যবহার করা । পরবর্তীতে নাসা ঘোষণা দেয় যে তারা ক্রিমিয়া সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বাদে অন্য সব ক্ষেত্রে রাশিয়ার সাথে সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ রাখবে। রুশ মহাকাশ সংস্থার চিফের টুইট বার্তাকে তৎকালীন নাসা চিফ খুব একটা সিরিয়াসলি নেননি। তার মতে তারা পৃথিবীর কোনো দ্বন্দ্বকে মহাকাশে নিয়ে যেতে রাজি নন ।তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, তারা দু দেশের মধ্যকার স্পেস ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশন কন্টিনিউ করবেন যা তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্বকে নির্দেশ করে । সাম্প্রতিক ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে রুশ মার্কিন সম্পর্ক প্রায় তলানিতে পৌঁছেছে স্নায়ু যুদ্ধের অবসানের পর তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আগে কখনোই এতটা খারাপ হইনি। কিন্তু এত কিছুর পরেও দুই পক্ষের মহাকাশে যে সহযোগিতা সম্পর্ক তা বজায় রয়েছে এখনো পর্যন্ত. রাশিয়া মার্কিন মহাকাশচারীদের মহাকাশে রেখে আসেনি. বরং সুইজে করে তাদেরকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে. এমনকি সম্প্রতি রাশিয়া মহাকাশে নতুন একদল রুশ নভোচারী পাঠিয়েছে. এ থেকে প্রমাণিত হয় যে এখনো পর্যন্ত সকল দেশের সহায়তায় আইএসএস ভালোভাবেই চলছে । পৃথিবীর ভূরাজনৈতিক যে সমস্যা তা এখনো পর্যন্ত অন্তত মহাকাশে পৌঁছায়নি.
গত এক দশকে মহাকাশে নানান অজানা দিক জানানোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছে । কিন্তু এটা সত্য যে এই স্টেশনটি এখন বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। এই স্টেশনে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতার যে চুক্তি রয়েছে তার মেয়াদ শেষ হবে দু হাজার চব্বিশ সালে । যদিও আমেরিকায় এটাকে দু হাজার ত্রিশ সাল পর্যন্ত বাড়াতে চায় । রাশিয়া এখনো এই ব্যাপারে কোনো সম্মতি দেয়নি এবং চুক্তিও স্বাক্ষর করেনি । যদি দুই দেশের চুক্তি স্বাক্ষর হয় ভবিষ্যতে স্পেস প্রোগ্রাম নিয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলো আগামী দিনে নিজেদের মালিকানাধীন স্পেস স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা করছে. এদিকে নাসা ও এইসব বেসরকারি স্পেস স্টেশনের ওপর নির্ভর করে কাজ করতে চায়. নাসা চাইছে অন্যান্য দেশের সহযোগিতায় আর্টিমিস প্রোগ্রাম তৈরি করতে. যেটার মাধ্যমে তারা আবারও চাঁদে মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারবে.
পর তারা ধীরে ধীরে মঙ্গল গ্রহের জয়ের দিকে যাত্রা করতে চায়। কিন্তু আমেরিকার এই উদ্দেশ্যের সাথে দুটি দেশ এখনো একমত হয়নি ।কারণ তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে রাশিয়া বর্তমানে নিজস্ব স্পেস স্টেশন তৈরীর পরিকল্পনা করছে অন্যদিকে চীন এবছরের মধ্যেই তাদের নিজস্ব স্পেস স্টেশন তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে চায়. আমেরিকার পর বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে চাঁদের পৃষ্ঠে নিজেদের পতাকা স্থাপন করেছে চীন. যা অবশ্যই তাদের মহাকাশ জয়ের পথে নতুন এক মাইল ফলক.
যদি দুহাজার-চব্বিশ সালের পর রাশিয়া আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে অংশগ্রহণ না করে তখন নেভিগেশনসহ আইএসএসের যে সকল বিষয় বর্তমানে রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে তা হয়তো আমেরিকার ডিজাইন করতে হতে পারে আর এই কাজে আমেরিকাকে হয়তো এলন মাস্কের স্পেস এক্সের এর মত বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সহায়তা নিতেই হবে। স্পেস এক্সের তৈরি প্রথম ফ্যালকন ওয়ান নামক রকেট প্রথম চেষ্টায় অরবিটে পৌঁছতে সক্ষম হয়. এ যাবৎ স্পেস এক্স পরিচালিত মোট সাতাশিটি স্পেস মিশনের মধ্যে পঁচাশিটি মিশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে. দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটি নিজস্ব রকেটে মহাকাশে স্যাটেলাইট যাত্রী এবং কার্গো পরিবহনের কাজ সফলভাবে করে আসছে। দু হাজার বিশ সালে তাদের সফলভাবে সম্পন্ন করা মিশন রাশিয়ার সুইজের ওপরে নির্ভরশীলতা কমিয়েছে অনেকটাই। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সহযোগিতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন.
ইউক্রেন সংকট হয়তো বা এই স্টেশনে সহযোগিতার পথ বন্ধ করে দেবে. কিংবা এই স্টেশনটি হয়তো বা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে. কিন্তু এটা আসলে পূর্বেই অনুমিত ছিল. এখন হয়তো এই সংকটের কারণে বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াটা আগের চেয়ে একটু দ্রুততর হবে. কিন্তু মূল চিন্তার বিষয় এটা নয় যে আইএসএস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা বন্ধ হয়ে যাবে যেটা চিন্তার বিষয় তা হলো ভবিষ্যতে মহাকাশে বিভিন্ন দেশের মধ্যকার সহযোগিতার লক্ষ্যে আর কোনো কমন গ্রাউন্ড বা প্ল্যাটফর্ম হয়তো থাকবে না। সবাই আলাদা আলাদা ভাবে মহাকাশে নিজ নিজ খুঁটি গেড়ে বসতে চাইবে। পৃথিবী এখনো পর্যন্ত অনেক যুদ্ধ বিগ্রহ দেখেছে. ভবিষ্যতে হয়তো মহাশূন্যর সাক্ষী হবে যুদ্ধ বা বিশ্বযুদ্ধের.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন